মনিরুলকে হত্যার পর কনস্টেবল কাওছার তাণ্ডব চালান

রাজধানীর গুলশানে ফিলিস্তিন দূতাবাসের সামনে সহকর্মী মো. মনিরুল হককে (২৭) উপর্যুপরি গুলি চালিয়ে হত্যা করেন কনস্টেবল কাওছার আলী (৪১)। হত্যা করেই শান্ত থাকেননি তিনি। হত্যার পর ওই এলাকায় বন্দুক হাতে প্রায় আধা ঘণ্টা তাণ্ডব চালান তিনি। এমনকি হত্যাকাণ্ডের পর মরদেহের পাশে দাঁড়িয়ে ধূমপানও করেন কাওছার। বন্দুক হাতে এক পাশ থেকে আরেক পাশ হাঁটছিলেন এই পুলিশ সদস্য। আতঙ্ক ছড়াতে ওপরের দিকে ফাঁকা গুলিও ছোড়েন। গুলির শব্দ শুনে আশপাশ থেকে সেখানে যাওয়া পুলিশ সদস্য এবং পথচারীদের লক্ষ্য করেও গুলি চালান কাওছার। তার এলোপাতাড়ি গুলিতে গুরুতর আহত হন জাপানি অ্যামবাসিতে কর্মরত ড্রাইভার মো. সাজ্জাত হোসেন।

গত শনিবার রাতে এই হত্যার ঘটনার পর থেকে কাওছার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় আধা ঘণ্টা সময়ের মধ্যে এসব ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনাতে তার এই তাণ্ডবের কথা উঠে এসেছে।

সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শনিবার রাত তখন প্রায় সাড়ে ১১টা পেরিয়েছে। সময়সূচি অনুযায়ী গুলশানে ফিলিস্তিন দূতাবাসের সামনে দায়িত্ব পালন করছিলেন কনস্টেবল কাওছার এবং মনিরুল। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কোনো একটা বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল তাদের মধ্যে। কথা বলতে বলতে একসময় পুলিশ বক্সের ভেতরে ঢোকেন কাওছার। সেখান থেকেই ১১টা ৪০ মিনিটে নিজের হাতে থাকা অস্ত্র দিয়ে মনিরুলকে গুলি করেন তিনি। প্রথম গুলির পরই ফুটপাত থেকে রাস্তায় পড়ে যান মনিরুল। এরপর পুলিশ বক্স থেকে বের হয়ে তাকে টানা ৮ থেকে ৯ রাউন্ড গুলি করেন কাওছার। গুলিতে মনিরুলের বুক, পিঠ এবং চোখ ঝাঁজরা হয়ে যায়।

এ ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী এম এ সিফাদ কোরাইশী সুমন। তিনি মানিকগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। ঘটনার আগে ফিলিস্তিন অ্যাম্বাসির পাশে সাবেক এক মন্ত্রীর বাসায় গিয়েছিলেন তিনি। ওই বাসা থেকে ফেরার পথে এ লোমহর্ষক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। তিনি জানান, রাত সাড়ে ১১টার দিকে ফিলিস্তিন দূতাবাসের একদম অদূরের একটি ভবন থেকে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং শেষ করে তারা কয়েকজন বের হন। এরপর হাঁটতে হাঁটতে দূতাবাসের উল্টোপাশে এসে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন। এ সময় দুই পুলিশের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় তাদের কানে আসছিল। হঠাৎ তাদের কানে গুলির আওয়াজ আসে। তারা দৌড়ে কিছুটা দূরে চলে যান। সেখান থেকে দেখতে পান একজন পুলিশ সদস্য আরেক পুলিশ সদস্যকে রাস্তায় ফেলে গুলি করছে।

তিনি বলেন, এমন দৃশ্য চোখে দেখব কখনো ভাবিনি। চোখের সামনে একজন আরেকজনকে এভাবে মেরে ফেলল। তবে এর পরের ঘটনা ছিল আরও ভয়ংকর। ঘটনার পরপরই এক লোক সাইকেল দিয়ে ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। আমরা ওই লোককে বললাম, এদিকে যাবেন না, গোলাগুলি হচ্ছে। উনি বলেন, জাপানি অ্যাম্বাসিতে চাকরি করেন, এখানকার সবাই তার পরিচিত। উনি সাইকেল দিয়ে গিয়ে ওই পুলিশকে জিজ্ঞেস করলেন যে কী হয়েছে। এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ওই লোককে লক্ষ্য করে দুটি গুলি ছোড়ে। এরপর গুলির শব্দ শুনে আশপাশ থেকে কয়েকজন পুলিশ সদস্য এলে তাদের দিকেও গুলি ছোড়েন তিনি। তবে তাদের গায়ে গুলি লাগেনি। এ সময় ওই রাস্তা দিয়ে যে গাড়িই আসছিল, সে গাড়ির দিকে তাক করেই গুলি চালাচ্ছিলেন তিনি।

নিজের বন্দুকের গুলি শেষ হয়ে যাওয়ার পর, হত্যার শিকার ওই পুলিশের বন্দুক নিয়ে গুলি চালাতে থাকেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি প্রায় ৪-৫টি সিগারেট খান। মরদেহের পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে ফাঁকা গুলি করেন। একসময় বন্দুকের গুলি শেষ হয়ে গেলে তিনি রাস্তায় গিয়ে বসে থাকেন। প্রায় আধা ঘণ্টা এমনভাবে চলার পর ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে। এরপর ওই পুলিশ সদস্য কোনো প্রতিবাদ না করে হাত উঁচিয়ে সারেন্ডার করেন। মনে হচ্ছিল সিনেমার কোনো দৃশ্য। ঘটনার পর আমাদের সঙ্গে থাকা এক বড় ভাই স্থানীয় গুলশান থানার ওসিকে ফোন দিয়ে ঘটনা জানান। এরপর পুলিশ এবং সোয়াত সদস্যরা আসেন।

ঘটনার বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, দায়িত্ব পালনের সময় কনস্টেবল মনিরুল হকের সঙ্গে কনস্টেবল কাওছার আলীর তর্কাতর্কির ঘটনা ঘটে। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে কনস্টেবল কাওছার ৮-৯ রাউন্ড গুলি ছোড়েন সহকর্মী মনিরুলকে উদ্দেশ করে। তবে কী নিয়ে তর্ক ও কী কারণে কাওছার উত্তেজিত ছিলেন, সে বিষয়ে এখনো জানাতে পারেনি পুলিশ। সাময়িক উত্তেজনার কারণেই হয়তো অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনা ঘটেছে। আমরা প্রাথমিকভাবে তাদের মধ্যে বিরোধের কোনো বিষয় পাইনি।

কাওছারের স্ত্রী জানান, শনিবার বিকেলে স্বামীর সঙ্গে তার সর্বশেষ কথা হয়। সে সময় কাওছার বলেছিলেন, ঈদের ছুটির জন্য ৪ তারিখ আবেদন করেছেন। এবার ঈদে বাড়িতে আসবেন। তিনি বলেন, কাওছারের মানসিক সমস্যা ছিল। রাঙামাটির বরকলে চাকরি করার সময় তিনি মানসিক সমস্যায় ভোগেন। এরপর বিভিন্ন সময় সরকারিভাবেই তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে অন্তত তিনবার চিকিৎসা করানো হয়। নিয়মিত ওষুধও সেবন করতেন। তার কাছে প্রেসক্রিপশনও আছে। তবে আমাদের পরিবারে কোনো অশান্তি ছিল না। মানসিক সমস্যা থাকলেও তিনি কোনো মানুষকে হত্যা করতে পারেন, তা আমার বিশ্বাস হয় না।

নিহত মো. মনিরুল হকের ভাই গতকাল রোববার চাঞ্চল্যকর এ হত্যার ঘটনায় রাজধানীর গুলশান থানায় মামলা করেছেন। এই মামলায় পুলিশ সদস্য কাওছারকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের কাছে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। আদালত তার ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) রিফাত রহমান শামীম বলেন, শনিবার ঘটনায় নিহতের ভাই মাহাবুবুল আলম বাদী হয়ে মামলা করেছেন।

error: