সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও অর্থপাচার ঠেকাতে কাজ করছে সরকারের বেশক’টি সংস্থা। তারপরও অর্থপাচার বন্ধ হচ্ছে না। নানা ফাঁক-ফোঁকরে পাচার চালিয়ে যাচ্ছে দুর্নীতিবাজরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থপাচারকারীরা দেশের শত্রু। তাদের প্রতিরোধ না করা গেলে অর্থনৈতিক অবকাঠামো ভেঙে পড়বে। আর তাই এ অপরাধ মোকাবেলায় আইনের কঠোর প্রয়োগের বিকল্প নেই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এখন অর্থপাচার মামলা পরিচালনা ও তদন্তে কাজ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ (ডিএনসি) একাধিক সংস্থা। এককভাবে কোনও সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান মানিলন্ডারিং মামলা পরিচালনা করছে না। অবশ্য দুদক ও সিআইডি ছাড়া অন্য সংস্থাগুলোর কাছে মানিলন্ডারিং মামলার তথ্য পাওয়া যায়নি।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী- ২০০৯ থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪১২টি মামলা এবং এক হাজার ৪৫৫টি ঘটনার অনুসন্ধান নিষ্পত্তি করে তারা। একই সময়ে এই ইউনিট ২৮২টি মানিলন্ডারিং মামলার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং ১৪৬টি মামলার নিষ্পত্তি করে। এতে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ, জমি, ফ্ল্যাট, বাড়ি ও গাড়ি জব্দ করা হয়।
সিআইডির তদন্তাধীন মানিলন্ডারিং মামলার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলা অন্যতম। এই মামলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরি করা ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কা থেকে ৩৪ মিলিয়ন ডলার উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৪ ধারা, মানিলন্ডারিং আইনের ৪(৪) এবং পেনাল কোডের ৩৭৯ ধারায় ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ মতিঝিল থানায় মামলাটি দায়ের করা হয়।
এ ছাড়াও আরও কিছু আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর মানিলন্ডারিং মামলা পরিচালনা করছে সিআইডি। সেগুলোর একটি হচ্ছে, কক্সবাজার-কেন্দ্রিক শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী চক্রের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের আগস্টে দায়ের করা টেকনাফ থানার ৭৪ নম্বর মামলা। মামলাটির তদন্ত শেষে ৪৩ মাদক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।
তদন্তে এই মামলায় অভিযুক্ত আসামিদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ইয়াবা বিক্রির প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। এ ছাড়া মাদক বিক্রির অর্থ দিয়ে কেনা ২৬৮ শতক জমি ও দু’টি বিলাসবহুল বাড়ি আদালতের অনুমোদনের পর ক্রোক করে রিসিভার নিয়োগ করা হয়।
ফারইস্ট ইসলামিক মাল্টিপারপাস কো অপারেটিভ লিমিটেডের কর্মকর্তারা প্রতারণার মাধ্যমে আমানতকারীদের প্রায় ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ সংক্রান্ত মানিলন্ডারিং আইনের ১৩টি মামলার তদন্ত করে সিআইডি। তদন্তে আত্মসাতের বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এসব মামলার মূল আসামি শামীম কবিরের একটি মাইক্রোবাস ও ব্যাংক হিসাবগুলো জব্দ করা হয়। আত্মসাত করা অর্থে কেনা ২৩ দশমিক ৪৬ একর আদালতের আদেশে ক্রোক করা হয়েছে।
টেরাকোটা টাইলস রফতানির নামে এসবি গ্রুপ জাল ও ভুয়া এলসির মাধ্যমে ২৩৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। এ অভিযোগে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে রাজধানীর মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলার মূল আসামি সালাউদ্দিন বাবলু কমার্স ব্যাংকের মাধ্যমে টেরাকোটা টাইলস রফতানির ভুয়া কাগজপত্র প্রস্তুত করে ব্যাংক থেকে ২৩৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। মামলায় কমার্স ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ১৩ কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা পেয়েছে সিআইডি। মূল আসামিদের ১০৮টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করাসহ ৬টি গাড়ি, ৫ কোটি টাকা মূল্যের একটি ফ্ল্যাট ও সাত কাঠা জমি ক্রোকের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। মামলাটির তদন্ত চলছে এখনও।
রাজধানীর খিলক্ষেত থানায় দায়ের করা ম্যাগনেটিক রাইস কয়েন সংক্রান্ত একটি প্রতারণার মামলাও তদন্ত করছে সিআইডি। আসামিদের প্রায় ৫০টির বেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সন্ধান পায় তারা। আদালতের অনুমতি নিয়ে সেসব অ্যাকাউন্টে রক্ষিত প্রতারণার প্রায় ৫ কোটি টাকা ফ্রিজ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতারণা করে অর্জিত ১৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা, ২টি গাড়ি ও একটি মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়েছে।
করোনার সময় প্রতারণাসহ নানা অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া সাহেদ করিমের বিরুদ্ধে উত্তরা থানায় দায়ের হওয়া একটি মানিলন্ডারিং মামলার তদন্ত চলছে। এ ছাড়াও ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় দায়ের হওয়া ১২টি মানিলন্ডারিং মামলার তদন্ত করছে সিআইডি। ক্যাসিনো মামলার তদন্তের সময় প্রায় ৩৫ কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ৪০৫ কোটি টাকা ফ্রিজ করা হয়েছে। এসব ঘটনায় ৯১ কাঠা জমি, দু’টি বাড়ি, ১২৭টি ফ্ল্যাট, ১৪টি গাড়ি শনাক্ত করেছে সিআইডি। যেগুলো ক্রোক করার আইনি প্রক্রিয়া চলছে।
অরগানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. মোস্তফা কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মানিলন্ডারিং আইনে করা মামলা যেগুলো আমাদের কাছে এসেছে সেগুলোর তদন্ত দ্রুত শেষ করে অভিযোগপত্র দেওয়ার চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে বেশক’টি চাঞ্চল্যকর মামলার তদন্ত শেষ করেছি। নতুন আরও কয়েকটির কাজ শুরু করেছি।
দুদকের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালের আগের বছরগুলোতে নিষ্পত্তি না হওয়া ৩৩টি অনুসন্ধান প্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছে। একই বছরে সাতটি মামলা দায়ের, নয়টি অভিযোগ পরিসমাপ্তি এবং ১৭টি অভিযোগ অন্য সংস্থায় পাঠানোর মাধ্যমে নিষ্পত্তি করেছে সংস্থাটি।
২০১৯ সালে মোট অনুসন্ধান করা হয় ১৫৩টি অভিযোগের। একই বছর অনুসন্ধান শেষ করা হয় ৩৩টির। মামলা দায়ের হয় সাতটি। নিষ্পত্তি হয় ২৬টির।
দুদকের জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক প্রণব কুমার ভট্টাচার্য জানান, বিদ্যমান মানিলন্ডারিং আইন অনুযায়ী মামলা পরিচালনার একক দায়িত্ব দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নেই। দুদক কেবল ঘুষ ও দুর্নীতি সম্পৃক্ত মানিলন্ডারিংয়ের অপরাধ তদন্তের ক্ষমতাপ্রাপ্ত। বাকি ২৬টি তদন্ত অন্যান্য সংস্থাগুলোর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।
২০১৯ সালের আগের বছরগুলোর অনিষ্পন্ন মানিলন্ডারিং তদন্তসহ মোট ৪৫টি তদন্তের মধ্যে ১৮টি মামলার তদন্ত শেষ করেছে দুদক। ১৩টি মামলার চার্জশিট অনুমোদন দিয়েছে। বাকি মামলাগুলোর মধ্যে তিনটি মামলা দুদকের আওতার বাইরে হওয়ায় সংশ্লিষ্ট সংস্থায় পাঠানো হয়েছে। দুটি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।
একই বছর (২০১৯) ১১টি মামলার বিচার কার্যক্রম শেষে আদালত আসামিদের সাজা দিয়েছেন। ওই বছরের শুরুতে মানিলন্ডারিংয়ে দুদকের অনিষ্পন্ন তদন্ত ছিল ২৪টি। ওই বছর আরও ২১টি তদন্ত গ্রহণ করা হয়। মোট তদন্তকাজ চালানো হয় ৪৫টির। তদন্ত শেষ করা হয় ১৮টির। চার্জশিট দাখিল করা হয় ১৩টির। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া দু’টিতে। নিষ্পত্তি করা হয় তিনটির।