আনোয়ার ইব্রাহিমের রথ দেখা ও কলা বেচা

মিজানুর রহমান:- সফরটি নিছক বন্ধুর প্রতি বন্ধুর ভালোবাসা থেকে এমনটি বলাবলি আছে। সফর প্রস্তুতিতে ছিল অবিশ্বাস্য তাড়াহুড়া। আনুষ্ঠানিকতার চাইতে অনানুষ্ঠানিকতাই হয়েছে বেশি। প্রটোকলের ব্যত্যয় তো বটেই। ডিপ্লোমেসিতে একটি বাক্য বেশ প্রচলিত। তা হলো- ‘নাথিং ইজ ফ্রি’। যেকোনো ইনভেস্টমেন্টের স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি ফল রয়েছে। সেটা ঘাম, শ্রম, অর্থ বা সময়- যা-ই হোক না কেন। রক্তাক্ত ঢাকার রাজপথ। লাশের স্তূপ। পালিয়েছেন শেখ হাসিনা। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বাংলাদেশের দায়িত্ব নিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে বিপ্লবী শিক্ষার্থীরা। কোনো ‘না’ নেই, তাকে প্রধান উপদেষ্টার গুরুদায়িত্ব নিতেই হবে। তিনি দ্বিধায়। দেশে থাকা ড. ইউনূসের কাছে মানুষরাও চাইছেন তিনি যেনো আসেন। হিসাবনিকাশ তখনো বাকি। অনিশ্চয়তা তো আছেই। সেই সময়ে যে ক’জন মানুষ তাকে সাহস ও উৎসাহ যুগিয়েছেন আনোয়ার ইব্রাহিম তাদের অন্যতম। ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের ৩ দিনের মাথায় ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের শপথ হয়। বঙ্গভবনের আনুষ্ঠানিকতা তখনো বাকি। তার আগেই ফোন করে প্রধান উপদেষ্টাকে স্বাগত জানান মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। সেদিনই কথা দিয়েছিলেন তিনি সুযোগ পেলে বাংলাদেশে আসবেন। বাস্তবেও তা-ই করে দেখালেন। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর কোনো বিদেশি রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের এটাই ছিল প্রথম সফর। পেশাদাররা বলছেন, ৪ঠা অক্টোবর ৫ ঘণ্টা ঢাকায় ছিলেন আনোয়ার ইব্রাহিম। এই সফরের আমন্ত্রণপত্র পাঠানো ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। মূলত তিনি এসেছেন বন্ধুর টানে। বন্ধুকে দেখতে। রাষ্ট্রীয় সফরে তিনি ছিলেন পাকিস্তানে। বাংলাদেশের উপর দিয়ে গেছেন ৩ দিন আগে। গন্তব্যে ফেরার পথে বাংলাদেশে নামলেন। তা-ও ক’ঘণ্টার জন্য। আনোয়ার ইব্রাহিম এর আগেও বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখনকার প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ইস্যু অনেক। বাংলাদেশ দুনিয়ার দেশে দেশে দক্ষ, আধাদক্ষ এবং অদক্ষ জনশক্তি পাঠায়। মধ্যপ্রাচ্যের পর আমাদের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় গন্তব্য মালয়েশিয়া। রাজনীতি এবং ক্ষমতার বলয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে সাধারণের নাভিশ্বাস। প্রায়শই জটিলতা হয়। জনশক্তির এই সম্ভাবনা মাঝে মধ্যে মুখ থুবড়েও পড়ে। এছাড়া ওআইসি ও আসিয়ান জোটের প্রভাবশালী সদস্য হিসেবে মালয়েশিয়ার কাছ থেকে আমাদের চাওয়া অনেক। আমরা আসিয়ান জোটে যেতে চাই নানা কারণে। ব্যবসা-বাণিজ্যের চেয়ে বড় বিষয় আমাদের ঘাড়ে চেপে বসা ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরাতে  আমরা আসিয়ানের অন্য সদস্যদের সাপোর্ট চাই। মালয়েশিয়া এখানে আমাদের সহায়তা করতে পারে। তাদের কাছ আমাদের চাওয়া অনেক। দেয়ারও আছে বেশ কিছু। এ নিয়ে আলোচনার ‘স্ট্র্যাকচার্ড ফর্মেট’ রয়েছে। দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যকার বৈঠক বরাবরই অর্নামেন্টাল। কিন্তু এবারে দেশটির প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের যে সফর এবং আলোচনা হয়েছে তার মাহাত্ম্য অনেক। ওয়াকিবহাল সূত্র  বলছে, এই সফরে ‘রথ দেখা কলা বেচা’ সবই হয়েছে। তবে নিঃশব্দে। প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ঢাকায় পৌঁছেছেন ভর দুপুরে। প্রটোকলের তোয়াক্কা না করে বন্ধুকে স্বাগত জানাতে সেদিন বিমানবন্দরে হাজির ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখান থেকে হোটেলে ফিরতে আলাদা গাড়ি থাকলেও তারা তা ব্যবহার করেননি। একসঙ্গে পাশাপাশি বসে আলাপ করতে করতেই ফিরেন। দুই সরকার প্রধানের সেদিনের অনানুষ্ঠানিক আলাপ ছাড়াও আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে। সব কিছুই ছিল আন্তরিকতাপূর্ণ। কেবল বরণ নয়, তাকে বিমানবন্দরে গিয়ে আন্তরিক বিদায়ও জানান প্রধান উপদেষ্টা। সাধারণত এমনটা হয় না। প্রধানমন্ত্রী বা প্রধান উপদেষ্টা স্বাগত জানালে এক গ্রেড নিচে অর্থাৎ পররাষ্ট্রমন্ত্রী, উপদেষ্টা বা সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি (মিনিস্টার ওয়েটিং) বিদায় জানান। কিন্তু আনোয়ার ইব্রাহিমের সফরে বরণ এবং বিদায়ে কোনো পার্থক্য টের পাওয়া যায়নি। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- স্বল্প সময়ের এই সফরে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি কিছু ঘটেছে। বিশেষ করে ১৮ হাজার জনশক্তিকে গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। মালয়েশিয়ার সাবাহ প্রদেশে বাংলাদেশিদের ব্যাপক চাহিদা। বিশেষ করে পেশাজীবীদের কাজের সুযোগ অবারিত। কিন্তু প্রাদেশিক সরকারের অনুমতি না থাকায় তা আটকে আছে। তাছাড়া মালয়েশিয়া জুড়ে কৃষি খাতের উন্নয়ন ও বাণিজ্য বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে ধান, মাছ উৎপাদনে সহায়তা করতে পারে বাংলাদেশ। এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে থাকার অঙ্গীকার তো বটেই। আসিয়ান জোটে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিতে লবিং করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। সেই সঙ্গে আঞ্চলিক অন্যান্য ইস্যু যেমন ভারত, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে এবং রাখতে ভূমিকা রাখবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। পেশাদাররা বলছেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সফর শুরু করার আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কথা হয় আনোয়ার ইব্রাহিমের। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি নিয়ে মোদির সঙ্গে কথা বলেন তিনি। বাংলাদেশ নিয়ে মোদির সঙ্গে কি আলাপ হয়েছে তা জানাতেই আনোয়ার ইব্রাহিম ঢাকা এসেছিলেন। বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে সঙ্গত কারণেই ভারত ও পাকিস্তানের শীর্ষ নেতৃত্বের আগ্রহ অনেক। পাকিস্তান সফরে কি আলাপ-আলোচনা হয়েছে সেটাও নিশ্চয়ই প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে জানিয়েছেন ‘পুরনো বন্ধু’ দাতো সেরি আনোয়ার ইব্রাহিম। 

সূত্র: জনতার চোখ।

error: