হোয়াইট হেলমেট নামে পরিচিত সিরিয়ার সিভিল ডিফেন্স গ্রুপ বলেছে যে, তারা দেশের কুখ্যাত সেদনায়া কারাগার থেকে মুক্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে পাওয়া বয়ানের তদন্ত করে দেখছে। ভূগর্ভস্থ এই কক্ষে দীর্ঘদিন ধরে তাদের আটকে রেখে অত্যাচার চালানো হতো। এক্সে একটি পোস্টে গ্রুপটি বলেছে যে, তারা এই কারাগারে পাঁচটি ‘বিশেষ দল’ মোতায়েন করেছে, যাদের সাহায্য করছে কারাগারের লে-আউটের সাথে পরিচিত একজন গাইড । বিদ্রোহীরা দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেয়ায় বন্দিদের মুক্ত করা হয়েছে এমন কারাগারগুলোর মধ্যে সেদনায়া অন্যতম। দামাস্কাস প্রদেশের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, বন্দিদের মুক্ত করার সময় দেখা গেছে কারাগারের অবস্থা এমন দুর্বিসহ ছিল যে কিছু বন্দি বায়ুচলাচলের অভাবে প্রায় দম বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছিল। দামাস্কাস কান্ট্রিসাইড গভর্নরেট সোশ্যাল মিডিয়ায় আসাদ সরকারের প্রাক্তন সৈন্য এবং কারাগার কর্মীদের কাছে বিদ্রোহী বাহিনীকে ইলেকট্রনিক আন্ডারগ্রাউন্ড দরজায় কোড সরবরাহ করার জন্য আবেদন করেছে। তারা জানিয়েছে যে, সিসিটিভি মনিটরে দেখা যায় এমন ১ লক্ষ বন্দিকে মুক্ত করার জন্য ইলেকট্রনিক আন্ডারগ্রাউন্ড দরজায় কোড প্রয়োজন। কারাগারের নীচের অংশে প্রবেশের প্রচেষ্টার ভিডিওটি অনলাইনে এবং আল জাজিরাসহ নিউজ আউটলেটের মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে।
অন্যান্য ফুটেজে দেখানো হয়েছে বন্দিদের মুক্তি দেয়া হচ্ছে, যার মধ্যে একটি ছোট শিশুকে তার মায়ের কাছে রাখা হয়েছে। তুরস্ক-ভিত্তিক অ্যাসোসিয়েশন অফ ডিটেনিস অ্যান্ড দ্য মিসিং ইন সেদনায়া প্রিজন (এডিএমএসপি) দ্বারা পোস্ট করা বন্দি মুক্তির একটি ভিডিওতে তাকে দেখানো হয়েছে। ভিডিওতে একটি কণ্ঠস্বরকে বলতে শোনা যায়, ‘ভয় পাবেন না, আসাদ সরকারের পতন হয়েছে।’
এএফপি দ্বারা যাচাইকৃত ভিডিওতে দেখা গেছে যে সিরিয়ানরা সেদনায়া থেকে মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে তাদের আত্মীয়স্বজন ছিল কিনা তা দেখতে ছুটে আসছে, এই কারাগারে আসাদ সরকারের অধীনে হাজার হাজার বিরোধী সমর্থককে নির্যাতন করা হয়েছে এবং মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বিদ্রোহী বাহিনী সিরিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে, সরকারী কারাগার থেকে বন্দিদের মুক্ত করেছে।
শনিবার হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) বলেছে যে তারা শহরটি দখল করার সাথে সাথে হোমস সামরিক কারাগার থেকে ৩৫০০ জনের বেশি বন্দিকে মুক্ত করেছে। সিরিয়ার দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর নামগুলোর একটি হল সেদনায়া কারাগার। দামাস্কাসের কাছে এই জেলে বন্দি ছিলেন সরকার বিরোধী হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দি।
২০১১ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরুর পর, সরকার বিরোধী প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে চালানো নিপীড়নের এক বড় কেন্দ্র হয়ে ওঠে সেদনায়া। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং সিরিয়ান অবজার্ভেটরি ফর হিউমান রাইটস -এর রিপোর্ট অনুসারে অনুমান করা হচ্ছে, ২০১১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে নির্যাতন, চিকিৎসা সেবার অভাব বা অনাহারে ৩০ হাজারেরও জনেরও বেশি বন্দিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে বা মারা গেছে। মুক্তি পাওয়া কয়েকজন বন্দির বয়ান মোতাবেক ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে কমপক্ষে আরও ৫০০ বন্দিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। ২০১৭ সালে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সেদনায়াকে ‘মানব কসাইখানা’ হিসাবে বর্ণনা করেছে। সেই সময়ে সরকার অ্যামনেস্টির দাবিগুলিকে ‘ভিত্তিহীন’ এবং ‘সত্য বর্জিত’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল। জোর দিয়েছিল যে সিরিয়ায় সমস্ত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সময় যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। সেদনায়ায় নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন এবং গণহত্যা ছিল স্বাভাবিক বিষয়। অনেকেই বহু বছর ধরে জানে না যে তাদের পরিবারের সদস্যটি এখনো জীবিত নাকি মৃত। এই কঠিন অগ্নিপরীক্ষা থেকে বেঁচে যাওয়া একজন ওমর আল-শোগ্রে রবিবার বিবিসিকে বলেছেন, কিশোর বয়সে তিন বছরের কারাবাসের সময় তিনি কী নির্যাতন সহ্য করেছিলেন।
ওমর বলেন, ‘আপনি সেখানে যে ব্যথা, একাকীত্ব, হতাশা অনুভব করবেন তা ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। তারা আমার চাচাতো ভাই, যাকে আমি খুব ভালোবাসতাম তাকে দিয়ে আমার ওপর নির্যাতন চালাতে বাধ্য করেছিল। অন্যথায়, আমাদের দুজনকেই মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ভয় দেখানো হতো ‘। সিরিয়ার একটি মানবাধিকার নেটওয়ার্ক অনুমান করে যে ২০১১ সাল থেকে ১ লক্ষ ৩০ হাজারেরও বেশি লোককে এই পরিস্থিতিতে আটকে রাখা হয়েছে। এমনকি প্রতিবেশী লেবাননেও, সিরিয়ার অন্ধকূপে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ভয় বহু বছর তাড়া করে বেড়িয়েছে। আর তাই কয়েক দশকের অন্ধকার থেকে আলোতে উদ্ভাসিত হওয়া সিরিয়ার এই মানুষগুলি এখনো বিশ্বাস করিতে পারছেন না যে আসাদ সরকারের পতন হয়েছে।
সূত্র: বিবিসি