ফেব্রুয়ারি শেষের দিক। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর মাত্র ১২ ঘণ্টা গড়াতেই দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানী প্রিটোরিয়ায় একটি আবাসিক ভবনে সমবেত হন একদল কর্মকর্তা। তাঁদের মধ্যে দেশটিতে অবস্থানরত রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার মন্ত্রী ও জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তারাও ছিলেন। রাশিয়ার একটি জাতীয় দিবস উদ্যাপনে যোগ দিয়েছিলেন তাঁরা।
ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায় নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ইলিয়া রোগাচেভ। অতিথির তালিকায় ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানসহ গণ্যমান্য সব ব্যক্তিরা। ইউক্রেনে হামলার পরও রাশিয়ার ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি তাঁরা।
শুধু দক্ষিণ আফ্রিকাই নয়, আফ্রিকার আরও অনেক দেশের সরকার ও নেতাদের কাছ থেকে ইউক্রেন হামলার সমর্থন পেয়েছে মস্কো। অনেকে আবার হামলার নিন্দা জানায়নি। আফ্রিকার দেশগুলোর এমন অবস্থান হতাশ করেছে ইউক্রেনকে সমর্থন দিয়ে আসা যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের।
ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর এর নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। ওই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় সাধারণ পরিষদের ১৪১টি সদস্য দেশ, বিপক্ষে অবস্থান নেয় পাঁচটি দেশ। জাতিসংঘে তোলা ওই প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত ছিল ৩৫টি দেশ।
এই ৩৫ দেশের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়াও জিম্বাবুয়ে, তানজানিয়া, উগান্ডা, সেনেগাল, মোজাম্বিক, মালি, আলজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলা, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, মাদাগাস্কার, নামিবিয়া, কঙ্গোসহ ১৭টি দেশই আফ্রিকার। যেখানে আফ্রিকার মোট দেশ ৫৪টি।
রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে আফ্রিকার দেশগুলোর এই অবস্থান ঘিরে নতুন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কয়েকজন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক। তাঁদের ধারণা, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে বিশ্ব যেমন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল, তেমনি আফ্রিকার দেশগুলোর এই সময়ে এসে নতুন মেরুকনে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।এ বিষয়ে প্রিটোরিয়াভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষক প্রিয়াল সিং বলেন, আফ্রিকার দেশগুলোর এই অবস্থান স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে যে বিভক্তি দেখা গিয়েছিল, সে কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। বর্তমান আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় তাদের এই অবস্থান এতটাই ব্যতিক্রম যে, স্নায়ু যুদ্ধপরবর্তী বিশ্ব ব্যবস্থা ও মূল্যবোধের প্রতি এসব দেশের প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষমতাসীন দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস মস্কোর সমালোচনা থেকে বিরত থেকেছে। সংকট সমাধানে বরং রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সংলাপের ওপর জোর দিয়েছে দলটি। একই পথে হেঁটেছে আরও কয়েকটি দেশ। ইউক্রেনে যুদ্ধের জন্য তারা পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোকেই দোষারোপ করছে। দেশগুলোর ভাষ্য, সংকট ঘিরে ‘দ্বিমুখী আচরণ’ করছে পশ্চিমারা।
আফ্রিকার অনেক দেশের রাশিয়ার প্রতি এই সমর্থন কাকতালীয় কোনো বিষয় নয়। বিশ্লেষকেরা বলছেন, মহাদেশটির অনেক দেশেই মস্কো সমর্থিত সরকার রয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হতে তাদের পাশে ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন।
দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে, অ্যাঙ্গোলা ও মোজাম্বিকের ক্ষমতাসীন দলগুলোর নেতাদের মনে রয়েছে, স্বাধীনতার স্বাদ পেতে কীভাবে তাদের অর্থ ও অস্ত্র থেকে শুরু করে পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন।
আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে ঐতিহাসিক এই সম্পর্ক গত কয়েক বছর ধরেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে রাশিয়া। দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি মস্কোর নানা বিবৃতি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তুলে ধরা হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফ্রিকায় বেশ কয়েকবার সফর করেছেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ।
প্রভাব বিস্তারে আফ্রিকার অস্থিতিশীল অঞ্চলগুলোর ওপর নজর দিয়েছে রাশিয়া। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক ও মালির মতো কয়েকটি দেশ থেকে উল্লেখ করার মতো ফলও এসেছে।
মালিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটির ক্ষমতাসীনরা মস্কোর সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক জোরদার করেছে। রাশিয়ার আধা সামরিক সংস্থা ওয়াগনার গ্রুপ দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের নিয়ে গড়ে তোলা। বেসরকারি এই সংস্থার কর্ণধার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ। ওয়াগনার গ্রুপের যোদ্ধারা সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক ও সুদানসহ আফ্রিকার ছয়টি দেশে লড়াই করছেন বলে ধারণা করা হয়। গত বৃহস্পতিবার ওয়াগনার গ্রুপের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ দিয়েছে যুক্তরাজ্য।
গত কয়েক মাসে রাশিয়ার কাছাকাছি এসেছে সুদান। গত বছর দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থান হয়। এরপর আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে একটি বন্দর রাশিয়াকে ২৫ বছরের জন্য ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে চুক্তি করেছে সুদান।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত প্রস্তাবের বিপক্ষে যে পাঁচটি দেশ ভোট দিয়েছিল, তার মধ্যে আফ্রিকার একমাত্র দেশ ছিল ইরিত্রিয়া। মস্কোর সঙ্গে এই দেশের কর্মকর্তাদেরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের আফ্রিকা প্রোগ্রামের উপপরিচালক পলিন বক্স বলেন, ‘আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলের মানুষের মধ্যে পশ্চিমাবিরোধী জোরালো মনোভাব রয়েছে। এ অঞ্চলের জনমতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রবণতা দেখা যায়। আর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মানেই হলো যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাবিরোধী।’
সূত্র:প্রথম আলো।