ট্রাম্পের প্রথম দুই বছর কি মসৃণ হবে!

নির্বাচনের রাতে ডনাল্ড ট্রাম্প বার বার যে বাক্য উচ্চারণ করেছেন, তাহলো- ‘প্রমিজেজ মেইড, প্রমিজেজ কেপ্ট’। অর্থাৎ প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। প্রতিশ্রুতি রেখেছি। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার মধ্যদিয়ে মার্কিন কংগ্রেসের আনুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ এখন তার দল রিপাবলিকানদের হাতে। একদিকে ট্রাম্প নিজে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত, অন্যদিকে কংগ্রেস তার দলের। ফলে  যেসব প্রতিশ্রুতি তিনি প্রচারণার সময় দিয়েছেন তা রক্ষা করা তার জন্য খুব এবং খুবই সহজ। যুক্তরাষ্ট্রের এবারের নির্বাচন ও ট্রাম্পের প্রশাসন নিয়ে এসব কথা লিখেছেন বিবিসি’র উত্তর আমেরিকা বিষয়ক সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট গ্যারি ও’ডনোঘু। তিনি লিখেছেন, ওয়াশিংটনের রাজনীতিতে ট্রাম্প ও রিপাবলিকানদের জয়ের এই ধারাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘গভর্নিং ট্রাইফেকটা’। যখন প্রেসিডেন্ট মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ ও উচ্চকক্ষ সিনেট উভয় কক্ষের নিয়ন্ত্রণ পেয়ে যান, তখনকার পরিস্থিতিকে এভাবে বর্ণনা করা হয়। এই নিয়ন্ত্রণ এখন ডনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান দলের আছে। এই নিয়ন্ত্রণ একটিমাত্র দলের কাছে থাকা সাধারণ বিষয়। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকগুলোতে এটা বিরল এবং এর মেয়াদ স্বল্পস্থায়ী হয়েছে। প্রায় দুই বছর পরে কংগ্রেসের মধ্যবর্তী নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা মাঝে মাঝেই আসন হারাতে থাকে।  হোয়াইট হাউসের প্রথম দুই বছর এই ‘গভর্নিং ট্রাইফেকটা’ পরিস্থিতি উপভোগ করেছেন ট্রাম্প এবং জো বাইডেন দু’জনেই। কিন্তু তারা দু’জনেই দেখেছেন এই নিয়ন্ত্রণ একজন প্রেসিডেন্টের সামনে এগুনোর জন্য কোনো গ্যারান্টি নয়। সিগনেচার হিসেবে ক্ষমতার প্রথম মেয়াদের প্রথম দুই বছর ট্রাম্প একটি ট্যাক্স বিল পাস করেন। এই বিলে তিনি করপোরেট ট্যাক্স শতকরা ৩৫ ভাগ থেকে কমিয়ে ২১ ভাগে নিয়ে আসেন। ব্যক্তিবিশেষের কিছু ট্যাক্স কমিয়ে দেন। কিন্তু ২০১৬ সালে তিনি বিস্ময়করভাবে নির্বাচিত হয়ে শীর্ষে চলে যাওয়ার ফলে নিজের দলের কিছু সদস্যের বাধার মুখে পড়েন। অন্য লক্ষ্যগুলো পূরণ করতে গিয়ে তাকে সংগ্রাম করতে হয়। তিনি অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট (যেটা ওবামাকেয়ার নামে পরিচিত) বাতিল করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। কারণ, তার দলের একজন শক্তিধর সিনেটর জন ম্যাকেইন-এর পক্ষে ভোট দিতে অস্বীকৃতি জানান। ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি অবকাঠামো বিষয়ক বিল পাস করবেন। তাতেও ব্যর্থ হন ট্রাম্প। ক্ষমতার প্রথম দুই বছর ডেমোক্রেট  প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও একই অবস্থায় পড়েন। ওই সময় কংগ্রেসের উভয় কক্ষ ছিল ডেমোক্রেটদের নিয়ন্ত্রণে। আমেরিকান রেসক্যু পরিকল্পনা, ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড জবস আইন এবং চিপস অ্যান্ড সায়েন্স অ্যাক্ট পাস করাতে সক্ষম হন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। কিন্তু তাকে ব্যয় ও বিনিয়োগ পরিকল্পনা থেকে ফিরে আসতে হয়। এর কারণ, তার নিজের দলের একজন সিনেটর এর বিরোধিতা করেছিলেন। সিনেটে কোনো বিল পাস করাতে গিয়ে কংগ্রেসে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও বড় বাধা হলো সিনেটে তিন-পঞ্চমাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা ৬০টি ভোট পেতে হয়। এ কারণে কোনো বিল পাস করানোর আগে তা নিয়ে  খোলামেলা বিতর্ক হয়। এর অর্থ হলো যখন সিনেটে একটি দল সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকে তারা বিল পাস করাতে গেলে সবাইকে তার আওতায় টানার চেষ্টা করে। 
আগামী ২০শে জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতায় আসছেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ট্রাম্প। এটি তার দ্বিতীয় দফার ক্ষমতা। একে ট্রাম্প ২.০ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। তার এই দ্বিতীয় মেয়াদে রিপাবলিকানদের জন্য ‘গভর্নিং ট্রাইফেকটা’ কেমন হবে! এবার সিনেটে তারা স্বাস্থ্যবান সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন। কিন্তু তার হাতে ম্যাজিক নাম্বার ৬০টি আসন থাকবে না। এটা যেকোনো বিলের বিরোধিতাকে কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন। বুধবার সিনেটে রিপাবলিকানরা ফ্লোরিডার সিনেটর রিক স্কটের পরিবর্তে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা হিসেবে নির্বাচিত করেছেন জন থুনে’কে। ট্রাম্প শিবিরের পরিষ্কার পছন্দের রিক স্কট। এর ফলে বড় এক আইনি লড়াইয়ের সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। ট্রাম্প বেশ কিছু বড় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তার মধ্যে আছে ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আকারে অভিবাসীদের দেশ থেকে বের করে দেয়া। বিদেশি পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক আরোপ। পরিবেশ সুরক্ষা থেকে সরে আসা। এসব ইস্যুতে দ্রুততার সঙ্গে সামনে এগুনোর চেষ্টা করবেন ট্রাম্প। এসব বিষয়কে বাস্তবায়ন করতে গেলে তাকে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা, এমনকি আদালতের মুখোমুখি হতে হবে। ক্ষমতার প্রথম মেয়াদে তিনি এমন বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। ওই সময় নির্বাহী আদেশ ব্যবহার করেছেন বিস্তৃতভাবে। কিন্তু নিয়মিতভাবে এবং সফলতার সঙ্গে সেসব উদ্যোগকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে। 
বিচারিক প্রেক্ষাপটও ট্রাম্পের পক্ষে পরিবর্তিত হয়েছে। তার প্রথম ক্ষমতার মেয়াদে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে চেয়েছেন সুপ্রিম কোর্টে তিনজন রক্ষণশীল বিচারককে বসিয়ে। এর উদ্দেশ্য হলো সম্ভবত সামনের দশকগুলোতে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে সুদৃঢ় করা। তিনি কমপক্ষে চার ডজন বিচারককে ফেডারেল আপিল কোর্টের জন্য নাম ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যদিয়ে তিনি আরও রক্ষণশীল হওয়ার চেষ্টা করেছেন। সিনেটে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা দিয়েছে। প্রশাসনিক পদগুলোতে খুব সহজেই ট্রাম্প তার পছন্দের লোকদের বসাতে পারবেন। এর আগে ২০১৭ সালে ক্ষমতায় থাকার সময় তিনি রিপাবলিকান দলের  ভেতর থেকে বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তা এখনো বিদ্যমান আছে। এসব মিলে আগামী দু’বছর ট্রাম্পের জন্য ব্যস্ত এবং সম্ভবত কঠিন সময় হতে পারে। সাম্প্রতিক ইতিহাস ইঙ্গিত করে যে, এই ‘গভর্নিং ট্রাইফেকটা’ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কিন্তু আসন্ন ট্রাম্প প্রশাসন সেই অবস্থাকে কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চাইবে।

error: