এক অদৃশ্য কোম্পানি। যেখানে চেয়ারম্যান চিনেন না এমডিকে। আবার এমডি চেনেন না চেয়ারম্যানকে। অফিসের ঠিকানাও ভুয়া। কাগজে-কলমে থাকলেও আদতে প্রতিষ্ঠানেরই অস্তিত্ব নেই। অথচ সেই প্রতিষ্ঠানের নামে দেশি-বিদেশি ডজন খানেক ছদ্মবেশী কোম্পানিতে বিপুল পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করে বাংলাদেশের জনপ্রিয় মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান নগদ। তবে বিনিয়োগের টাকার কানাকড়িও আর দেশে ফেরেনি। চলে গেছে তৃতীয় কোনো দেশে। এভাবেই গেল ৮ বছরে দেশের লাখ লাখ গ্রাহকের আমানতের শত শত কোটি টাকা কৌশলে হাতিয়ে নিয়েছেন নগদ সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের র্শীষ নেতা ও তাদের অনুসারীরা। এমনকি নগদ অপকর্মে জড়িয়ে গিয়েছিল শেখ হাসিনা সরকারের সরকারি কর্মকর্তারাও। জড়িত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর একজন উপ প্রেস সচিবও। অর্থ লুটপাটে জড়িত কেউ কেউ এখনো বহাল তবিয়তে আছেন। পড়েনি কোনো আইনের গ্যাঁড়াকলেও। অভিযুক্তদের অনেকে আবার নগদকে ঢেলে সাজানোর চবক দিচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগদের মালিকানা সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের নাকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেডের, এ নিয়ে দীর্ঘদিন কৌতূহল ছিল। সহসা এই সমস্যার জট খোলা যায়নি। কিন্তু ২০২১ সালের ১৬ই আগস্ট আন্তঃসংস্থার বৈঠকে নগদের মালিকানা বিরোধের অবসান হয়। তাও ছিল অস্পষ্ট। তবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরই বেরিয়ে আসে নগদের আসল চিত্র। বেরিয়ে আসে নানা অনিয়মের তথ্য।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভুয়া পরিবেশক ও এজেন্ট দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে আর্থিক জালিয়াতি এবং অতিরিক্ত ইলেকট্রনিক অর্থ বা ই-মানি তৈরি করা হয়। এই কারণে নগদের অন্তত ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকার হিসাব মিলছে না। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ পরিচালনায় যে প্রশাসক ও ব্যবস্থাপনা কমিটি বসিয়েছে। তাদের পরিদর্শনে এসব অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। বেরিয়ে এসেছে নগদের শেয়ার লেনদেনে ব্যাপক অনিয়মের চিত্র। অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগদের অনিয়মের শুরুটা ফিনটেক হোল্ডিংস লিমিটেড নামের একটি কোম্পানির মাধ্যমে। মূলত এটি একটি সফ্টওয়্যার প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। যা আর্থিক পরিষেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ডিজিটাল পরিষেবা, পরামর্শ ও আউটসোর্সিং’র সেবা প্রদান করে। এই ফিনটেকে নগদের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করে। যা প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের ৩.২ শতাংশ বা ৫ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। জয়েন্ট স্টক কোম্পানি এবং ফার্মের নিবন্ধক (আরজেএসসি) দেয়া তথ্য অনুযায়ী বনানীর ৩৬ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ এর ডেল্টা ডালিয়া টাওয়ারে এই ফিনটেক হোল্ডিংস লিমিটেড ঠিকানা দেখানো হয়েছে। কিন্তু ঠিকানা অনুযায়ী ১০ই মে ওই বহুতল ভবনে সরজমিন গিয়ে ফিনটেক নামের কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে এই ভবনেই নগদের মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস)এর প্রধান কার্যালয়। জানতে চাওয়া হলে ভবনের ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, আমি সাত বছর ধরে এই ভবনে ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করছি। তবে ফিনটেক হোল্ডিংস লিমিটেড নামে কোনো প্রতিষ্ঠান এখানে ছিল না। আমি আগে কখনো এমন নামও শুনিনি। এই ভবনে কোন তলার কী অফিস আছে, তা আমার মুখস্থ। কিন্তু এই কোম্পানির নাম জানা নেই। মূলত এই অস্তিত্বহীন কোম্পানিতে টাকা বিনিয়োগ করে নগদের টাকা ডিজিটাল গেটওয়ে ব্যবহার করে বিদেশে পাচার করা হয়।
সূত্র:মানবজমিন ।