বিশ্ব মানবাধিকার দিবস: ‘পরিস্থিতির অগ্রগতি নেই’ দাবি মানবাধিকার কর্মীদের, সরকার বলছে ‘ভালো’

জামাল উদ্দিন : বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ কমেনি, বরং সময়ের ব্যবধানে সেটা আরও বেড়ে যাচ্ছে। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে আশানুরূপ কোনও অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। কোভিডকালীন এই সময়েও অনেক ক্ষেত্রে মানবাধিকারের অবনতি হচ্ছে।  বিচার বহির্ভূত হত্যার ক্ষেত্রে এখনও বলা যাবে না যে, এটা কমে এসেছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ব্যাপক অপপ্রয়োগ হচ্ছে। এমন কোনও পেশার লোক নেই— যারা এই অ্যাক্টের অধীনে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন না। অন্যদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে— পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। মানুষের অধিকার রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। মানবাধিকার সমুন্নত রেখেই দেশকে সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ চলছে।

১০ ডিসেম্বর, আজ  বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। মানবাধিকার দিবসে এবারের  প্রতিপাদ্য হচ্ছে— ‘ঘুরে দাঁড়াবো আবার, সবার জন্য মানবাধিকার’। দিবসটি উপলক্ষে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ২২০ জন বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এদের বেশিরভাগ ঘটনা বছরের প্রথম তিন-চার মাসে সংগঠিত হয়েছে। ২৩৩ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে ২ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। নিখোঁজ হয়েছেন এক জন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হুমকির শিকার হয়েছেন ৩৯ জন। সরকার সমর্থিতদের হুমকির শিকার হয়েছেন ১৯ জন। সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে ৪১ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। নির্যাতনের শিকার হয়ে ছয় জন এবং গুলিতে মারা গেছেন ৩৫ জন। আহত হয়েছেন আরও ২২ জন। অপহরণের শিকার হয়েছেন ২২ জন।

সংস্থাটি জানায়, করোনাকালেও নারীর প্রতি সহিংসতা খুবই উদ্বেগজনক। গত জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে এক হাজার ৫৪৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫১ জন নারীকে। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় ৩১১ জনকে। ধর্ষণের শিকার হয়ে অপমানে আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন নারী। পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে ২২৩ জন নারী মারা গেছেন। যৌতুকের ১৩৮টি ঘটনায় শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৯০ জন। এরমধ্যে ৮৪ জন নারীর মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে ৫৩৫ জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। যেসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৪৯টি। এরমধ্যে ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশু রয়েছে ১১০ জন। ছয় বছরের নিচে ১২৫টি শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। এক হাজার ৬৩৮টি শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছে। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ৯৩৮টি। এরমধ্যে ছয় বছরের নিচে শিশু রয়েছে ১৯৮টি এবং ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশু রয়েছে ৩৭৩টি। যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন ১৮৯ জন নারী। সহিংসতার শিকার হয়ে ১৪ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। ৪১ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।  

দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মতামত জানতে চাইলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সিনিয়র ডেপুটি ডিরেক্টর নিনা গোস্বামী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এবার আমাদের স্লোগান হচ্ছে ‘ঘুড়ে দাঁড়াবো আবার, সবার জন্য মানবাধিকার’। এই প্রতিপাদ্যকে সামনে নিয়ে  এই যে, পেন্ডামিক পরিস্থিতিকে বাংলাদেশ মোকাবিলা করছে। সারা বিশ্বই মোকাবিলা করছে। কিন্তু বাংলাদেশের বিশেষ দিকটা হচ্ছে— এই সময়কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে ধর্ষণের বিষয়টা বেড়ে গেছে। এটা একমাত্র বাংলাদেশকেই সম্ভবত মোকাবিলা করতে হচ্ছে। পেন্ডামিক সব দেশেই আছে। কিন্তু এইভাবে কোনও দেশে ধর্ষণ বাড়েনি। এটা মানবাধিকারের সর্বোচ্চ লঙ্ঘন। এটা যাতে না হয়, আমরা যাতে সবাই মিলে ঘুড়ে দাঁড়াতে পারি, এটাই মূল চাওয়া।’

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে নিনা গোস্বামী বলেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড একটাও যাতে না হয়, জিরো হয়ে যায়, সেটাই আমরা চাই। যা কিছুই হোক সেটা যেনো আইনিভাবে হয়। আমরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছি। মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেকোনও ঘটনা বিশেষ করে এই জাতীয় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যতক্ষণ জিরোতে নেমে না আসছে, কোনও দেশের জন্য এটা সুখকর হতে পারে না। একটা ঘটনা হলেও সেটা আমরা ভয়ঙ্কর বলে মনে করি।’

দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন জানতে চাইলে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি এই কোভিডকালীন সময়েও অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দেখছি, অবনতি হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত মানবাধিকার পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয়েছে এটি বলার সুযোগ নেই। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে সামান্য কিছু পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করছি। তবে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বলার সময় এখনও আসেনি যে, এটি কমে গেছে বা আর হবে না।  কারণ, এর আগেও আমরা দেখেছি যে, বিশেষ বিশেষ সময় যখন জনগণের ভেতরে কোনও ঘটনাকে নিয়ে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়, তখন যদি জনগণের ভেতরে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দেয়, তখন রাষ্ট্র বা বাহিনীগুলোর তরফ থেকে কিছুটা নীরবতা আমরা লক্ষ্য করি। ক্রসফায়ারের ঘটনা কিন্তু মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের ঘটনার পরও ঘটেছে। বিজিবি ও পুলিশ ঘটিয়েছে। তাই এটি যে আর ঘটবে না, সেটা বলার সুযোগ এখনও আসেনি। এটা একেবারে কমে গেছে সেটা বলার সুযোগও আসেনি। এ বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত দুই শতাধিক মানুষ ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন। যার বেশিরভাগই প্রথম তিন চার মাসের মধ্যে হয়েছে।  তাই আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি।’

নূর খান লিটন আরও বলেন, ‘সীমান্ত হত্যা, ধর্ষণ, পারিবারিক সহিংসতা সবকিছু বেড়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, এই কোভিডকালীন সময়ে নারী ও শিশুদের ওপর নিপীড়ন বেড়েছে এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ব্যাপক অপপ্রয়োগ হচ্ছে। আমরা দেখেছি, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী ও পুরুষ শিক্ষক, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, দোকানদার, এমন কোনও পেশা নেই, যাদেরকে এই অ্যাক্টের আওতায় এনে হেনস্তা করা হচ্ছে না। রাজনৈতিক নানা বিষয়কে ট্যাগ লাগিয়ে অধিকার সংকুচিত করার এক ধরনের প্রচেষ্টা আমরা সরকারের পক্ষ থেকে লক্ষ্য করছি। যেমন সাম্প্রতিককালে পুলিশের অনুমোদন ছাড়া সভা সমাবেশ করা যাবে না, এই নির্দেশনাটিও মানুষের অধিকার খর্ব করছে। আর ডিজিটাল অ্যাক্টতো ব্যাপকভাবে অপপ্রয়োগ হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসকে সামনে রেখে এটাই বলতে চাই— বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি দিনকে দিন উদ্বেগ বেড়ে চলেছে। কখনও কখনও এটি এক ধরনের আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে যে, রাষ্ট্র আদৌ মানবাধিকারের সুরক্ষা দিতে পারবে কিনা। আর মানুষের মুক্তবুদ্ধির চর্চার ক্ষেত্র রাষ্ট্র ও বিভিন্ন গোষ্ঠীর মাধ্যমে সংকুচিত করা হচ্ছে। এটা বুঝতে যদি সরকার অক্ষম হয়, তাহলে অপশক্তি আমাদের গ্রাস করে ফেলবে।’

প্রায়ই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও বিভিন্ন দেশ মানবাধিকার পরিস্থিতি জানতে চায় সরকারের কাছে এবং মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক— এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মানবাধিকারের মানদণ্ডটা কী আমার জানা নেই। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, মানবাধিকার সমুন্নত রেখে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। সেজন্য মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য যা যা প্রয়োজন, সেগুলো বিবেচনায় রেখেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশ চালাচ্ছেন।’

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন।

error: