ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্প্রতি একটি বিশাল আকাশযুদ্ধ দেখেছি আমরা। অনেকে এটিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অন্যতম বড় আকাশযুদ্ধ বলেও অভিহিত করেছে। এই যুদ্ধে আমরা আকাশযুদ্ধের পরিবর্তিত রূপ দেখতে পাই।
আধুনিক আকাশযুদ্ধগুলো হয় দৃষ্টিসীমার আড়ালে, সাধারণত রাডার ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে।
আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে বহু মাইল দূর থেকেই শত্রু ক্ষেপণাস্ত্রকে খুঁজে বের করে ধ্বংস করা যায়। ফলে বিভিন্ন দেশ এখন বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করছে স্টেলথ প্রযুক্তি (অদৃশ্য বিমান), উন্নত এভিওনিক্স (বিমান নিয়ন্ত্রণ ও তথ্য প্রযুক্তি), এবং ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারের (বিদ্যুৎ তরঙ্গ ব্যবহার করে শত্রুর যন্ত্রপাতিকে বিভ্রান্ত করা) ওপর। এসব পরিবর্তন যুদ্ধের নীতিমালা ও কৌশলে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে — কারণ আধুনিক আকাশযুদ্ধ আর খোলা চোখে দেখা ব্যাটেলফিল্ড নয়, বরং প্রযুক্তিনির্ভর এক অদৃশ্য লড়াই।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আকাশে এই সংঘর্ষ শুধু পরমাণু অস্ত্রসজ্জিত দুই প্রতিবেশীর জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়; এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনের জন্যও বড় গুরুত্ব বহন করে।
এটি ছিল কয়েক দশকের মধ্যে দুই দেশের সবচেয়ে বড় সামরিক সংঘাত, যার প্রেক্ষাপট ছিল কাশ্মীরে সন্ত্রাসীদের হামলায় পর্যটকসহ কমপক্ষে ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনা।
অন্যান্য দেশগুলো এই সংঘাতে ব্যবহৃত সমরাস্ত্র এবং দুই দেশের সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছে, যাতে এ থেকে শিক্ষা নিয়ে তা বিভিন্ন ধরনের সংঘর্ষে প্রয়োগ করা যায়।
এই সংঘর্ষ চীনের সামরিক প্রযুক্তি ও অস্ত্র সরবরাহে ক্রমবর্ধমান ভূমিকার দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। কারণ চীন কৌশলগত অঞ্চলে তার প্রভাব বিস্তার করছে এবং এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে।
ভারত-পাকিস্তান ‘ডগফাইট’
একটি পাকিস্তানি নিরাপত্তা সূত্র সিএনএন-কে জানিয়েছেন, বুধবার প্রায় ১২৫টি ভারতীয় ও পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান আকাশযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, যা এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলে — এবং এটি সম্ভবত সাম্প্রতিক ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ ‘ডগফাইট’।
ভারত তাদের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার পাকিস্তানের দাবি অস্বীকার করেছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যতে যদি কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় যে পাকিস্তান সত্যি কোনো ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভেঙেছে, তাহলে সেটা ভারতের জন্য বড় ধরনের ভুল বা ব্যর্থতা হিসেবে ধরা হবে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স-এর তথ্য অনুযায়ী, ভারত ফ্রান্সে তৈরি আধুনিক রাফাল যুদ্ধবিমান ব্যবহার করছিল।
যুক্তরাজ্যের শীর্ষ প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা থিঙ্ক ট্যাংক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট (আরইউএসআই)-এর অ্যাসোসিয়েট ফেলো ওয়াল্টার লাডউইগ নিউজউইক-কে বলেন: ‘এটি [রাফাল] ভারতের অস্ত্রভান্ডারে একটি অত্যন্ত আধুনিক যুদ্ধবিমান এবং বিশ্বের শীর্ষ সারির ফাইটার জেটগুলোর মধ্যে একটি। ভারতীয় বিমানবাহিনীকে আধুনিকায়নের পথে রাফাল সংগ্রহ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।’
আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধবিমান ব্যবহারের ফলে এখন আর ‘ডগফাইট’ মানে শুধু কাছাকাছি থেকে মুখোমুখি লড়াই নয়। এখন এর মধ্যে দূর থেকে আক্রমণ করাও পড়ে, যাকে বলা হয় বিয়ন্ড-ভিজ্যুয়াল-রেঞ্জ (বিভিআর) — মানে চোখে দেখা যায় না, এত দূরে থেকে লড়াই হয়।
সিএনএন-এর তথ্য অনুযায়ী, এই যুদ্ধে দুই পক্ষ একে অপরের দিকে ১০০ মাইলেরও বেশি দূর থেকে দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছিল।
বিশেষজ্ঞ লাডউইগ বলছেন, ‘বিমান যুদ্ধের মান অনুযায়ী ১০০ মাইল খুব বেশি না। আদর্শভাবে, যে কেউ চাইবে টার্গেটকে কয়েক শত মাইল দূর থেকেই ধ্বংস করতে।’
গত কয়েক দশকে বিয়ন্ড-ভিজ্যুয়াল-রেঞ্জ (বিভিআর) ক্ষেপণাস্ত্রই আকাশযুদ্ধের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে। এখন যুদ্ধের ফল শুধু বিমান চালানোর কৌশল বা গতির ওপরই নির্ভর করে না, বরং সেন্সর, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং দূর থেকে টার্গেট ধ্বংস করার ক্ষমতার ওপরও নির্ভর করে।
সাবেক মার্কিন বিমানবাহিনীর অফিসার ও প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক জন স্টিলিয়ন ২০১৫ সালে সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড বাজেটারি অ্যাসেসমেন্ট (সিএসবিএ)-এর এক প্রতিবেদনে লেখেন: ‘২০ বছর আগে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধে (১৯৯১)- উন্নত সেন্সর, অস্ত্র, এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যবহার করা শুরু হয়েছিল, যার ফলে কাছাকাছি লড়াই [যেমন পুরনো ডগফাইট] কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। এর বদলে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং উন্নত সেন্সর দিয়ে শত্রুকে আক্রমণ করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।’
চীনের উত্থান
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খাজা মোহাম্মদ আসিফ এবং এক মার্কিন কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, পাকিস্তান চীনে তৈরি জে-১০ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে ভারতীয় যুদ্ধবিমানের বিরুদ্ধে আকাশ থেকে আকাশে হামলা করতে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে।
যদি নিশ্চিত হওয়া যায় যে জে-১০ যুদ্ধবিমানগুলো কয়েকটি রাফাল যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে, তবে এটি চীনা যুদ্ধবিমানগুলোর উন্নতির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হবে। এছাড়া, এটি চীনের বিমান প্রযুক্তির অগ্রগতি সম্পর্কে নতুন ধারণা দেবে।
বিশেষজ্ঞদের একটি ক্রমবর্ধমান দল চীনা যুদ্ধবিমানগুলোর গুণ, কর্মক্ষমতা এবং সক্ষমতা পর্যালোচনা করার চেষ্টা করছে। তারা যাচাই করছে এই বিমানগুলোকে কীভাবে পশ্চিমা দেশগুলোর সমমানের বিমান বা সিস্টেমের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট (আরইউএসআই)- ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত এক গবেষণায় উল্লেখ করেছে, চীন এখন আর রাশিয়া থেকে যুদ্ধবিমান আমদানি করে না; তারা নিজেরাই আধুনিক যুদ্ধবিমান, সেন্সর ও সমরাস্ত্র তৈরি করছে। এর ফলে চীন কিছু গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধবিমান প্রযুক্তির ক্ষেত্রে রাশিয়ার থেকেও এগিয়ে গেছে।
মানুষ কি বলছে
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (আরইউএসআই)- সহযোগী ফেলো ওয়াল্টার লাডউইগ নিউজউইককে বলেছেন: ‘আমার মনে হয়, এই ঘটনা আমাদের এমন এক ধরনের আকাশযুদ্ধের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে, যা আমরা অনেকদিন দেখিনি। কারণ বেশ অনেক বছর যুদ্ধবিমান ও এই ধরনের বিষয় কিছুটা গৌণ হয়ে পড়েছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন আমরা আবার এমন এক পরিস্থিতিতে ফিরে এসেছি, যেখানে দুইটি রাষ্ট্র তাদের প্রধান অস্ত্র নিয়ে মুখোমুখি হচ্ছে।’
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (আইআইএসএস)- এর মিলিটারি অ্যারোস্পেস বিষয়ক সিনিয়র ফেলো ডগলাস ব্যারি রয়টার্সকে বলেন: ‘চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশের বিমানযুদ্ধ–সংশ্লিষ্ট মহল এই সংঘর্ষের কৌশল, পদ্ধতি, প্রযুক্তি, ব্যবহার করা সরঞ্জাম, কোনটা কার্যকর ছিল আর কোনটা ছিল না— এসব বিষয়ে যতটা সম্ভব বাস্তব তথ্য সংগ্রহে অত্যন্ত আগ্রহী হবে।’
সূত্র: the standard business