কারাগারে থাকা অবস্থায় লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় শোক ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ও ই সি ডি ভুক্ত ১৩টি দেশের ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূতরা।
ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে গত বছর মে মাসে আটক হওয়া লেখক মুশতাক আহমেদ কাশিমপুর কারাগারে ছিলেন। বৃহস্পতিবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ার পর হাসপাতালে নেয়া হলে তিনি মারা যান।
এক যৌথ বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৩ দেশের রাষ্ট্রদূতরা কী পরিস্থিতিতে মুশতাক আহমেদের মৃত্যু ঘটেছে – তার দ্রুত, স্বচ্ছ ও স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।
এই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, নরওয়ে, স্পেন, সুইডেন, সুইৎজারল্যান্ড ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতবৃন্দ, এবং যুক্তরাজ্য ও ক্যানাডার হাইকমিশনাররা।
মুশতাক আহমেদের বিরৃদ্ধে ফেসবুকে একটি বিদ্রূপাত্মক কার্টুনের ক্যাপশন দেয়া এবং সরকারের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে মামলা করা হয়েছিল।
বাংলাদেশের সরকার বলছে, মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর কারণ যাই হোক – তা তদন্ত করে দেখা হবে।
রাষ্ট্রদূতরা বিবৃতিতে আরো বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্টের ধারাসমূহ এবং তার বাস্তবায়ন, ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনসমূহের সাথে এর সঙ্গতিবিধান নিয়ে তাদের যে বৃহত্তর উদ্বেগগুলো রয়েছে – তা নিয়ে তারা বাংলাদেশের সরকারের সাথে কাজ করে যাবেন।
এছাড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচও এক বিবৃতিতে মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর স্বচ্ছ ও স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।
বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর বিক্ষোভ
এর আগে শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক বামপন্থী ছাত্র সংগঠন মৃত্যুর প্রতিবাদ জানাতে বিক্ষোভ সমাবেশ করে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি বিদ্রূপাত্মক কার্টুনের ক্যাপশন দেয়া এবং সরকারের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে গত বছরের মে মাসে লেখক মুশতাক আহমেদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা দায়ের করা হয়।
ওই মামলায় গ্রেফতারের পর গত নয় মাস ধরে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে বন্দী ছিলেন তিনি।
এ নিয়ে তিনি ছয়বার জামিন আবেদন করলেও তা নাকচ হয়ে যায়।
সামনের সপ্তাহে তার হাইকোর্টে তার জামিন শুনানির কথা ছিল।
তার আগেই কারাগারে কিভাবে মুশতাক আহমেদের মৃত্যু হলো – তার সঠিক কারণ বের করতে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করেছেন বিক্ষোভকারীরা।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের পাশাপাশি এই আইনের আওতায় সব বন্দিদের অবিলম্বে মুক্তির দাবিতে তারা স্লোগান দেন।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের নেতা মনীষা চক্রবর্তীর মতে, এটি কোন স্বাভাবিক মৃত্যু নয় বরং পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
তিনি বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে একদিকে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপরে মানসিক নিষ্পেষণ চালানো হচ্ছে, অপরদিকে, রাষ্ট্রীয়ভাবে কারাগারে হত্যাকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। “
“আমরা এর নিন্দা জানাই এবং অবিলম্বে মুশতাক হত্যার বিচার চাই এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল দেখতে চাই।”
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদ যেকোনো মানুষকে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার দেয়। সেক্ষেত্রে কেউ লেখালেখি বা আঁকাআঁকির জন্য গ্রেফতার হতে পারেন না বলে জানিয়েছেন ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, লিটন নন্দী।
তিনি বলেন, “যেখানে একজন ধর্ষককে, একজন জঙ্গিকে জামিন দেয়া হয়, সেখানে একজন লেখককে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে নির্যাতন করে, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়। এটি একটি রাষ্ট্রীয় খুন, এই দায় সরকারকে নিতে হবে। এই আইনের আওতায় যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের সবার মুক্তি দিতে হবে অনতিবিলম্বে।”
আবার বিক্ষোভে অংশ নিতে এসে মারজিয়া প্রভা জানান, যারা এই ঘটনার বিচার করবে তারাই শোষক রূপে আবির্ভূত হয়েছে। এ কারণে তিনি সরকার পতনের দাবি জানান।
‘কারাগারের কক্ষেই সংজ্ঞা হারান মুশতাক‘
কাশিমপুর কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার গিয়াস উদ্দিন জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর কারাগারের কক্ষে মুশতাক হোসেন হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়েন।
পরে তার কক্ষে থাকা বাকি দুজন চিৎকার করলে কর্তব্যরতরা প্রথমে তাকে কারাগারের হাসপাতালে এবং পরে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।
সেখানকার চিকিৎসকদের দাবি, হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।
মি. উদ্দিন বলেন, “তিনি যে অসুস্থ, এমন কোন অভিযোগ আগে করেননি। মাঝে মাঝে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেতেন। গতকাল (বৃহস্পতিবার) হঠাৎ করেই তিনি অচেতন হয়ে যাওয়ার পর হাসপাতালে নিলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন।”
“যেহেতু ডেথ সার্টিফিকেটে তার মৃত্যুর কোন কারণ দেয়া হয়নি তাই সঠিক কারণ জানতে লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করা হয়েছে।”
অচেতন অবস্থায় মুশতাক আহমেদকে হাসপাতালে নেয়ার সময়ও তার হাতে হাতকড়া পড়ানো হয় বলে যে অভিযোগ উঠেছে সেটাও অস্বীকার করেন মি. গিয়াস উদ্দিন।
“তিনি অচেতন ছিলেন বলে হ্যান্ডকাফ ছিল না। হ্যান্ডকাফ থাকলেও অসুবিধা কি, এটা তো নিরাপত্তার জন্যই পরানো হয়।” তিনি বলেন।
দুপুরে গাজীপুরের ওই হাসপাতালে মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হওয়ার পর লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
হাসপাতালটির ফরেনসিক বিভাগের প্রধান শাফি মোহায়মেন জানান, মরদেহের শরীরে তারা দৃশ্যমান কোন আঘাতের চিহ্ন দেখতে পাননি, তবে রিপোর্ট পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।
একই কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। চট্টগ্রামে পুলিশ সুপারের অফিস উদ্বোধন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, দেশের আইন ও অন্যের বিশ্বাসে আঘাত করে লেখালেখির কারণে মুশতাক আহমেদের বিরুদ্ধে অনেকেই মামলা করেছেন।
২০২০ সালে এমনই এক মামলায় তিনি কাশিমপুর কারাগারে বন্দী ছিলেন।
তবে তার মৃত্যুর কারণ যাই হোক, সেটা তদন্ত করা হবে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “সব মৃত্যুরই তদন্ত হয়, সেটা কারাগারে হোক বা দুর্ঘটনায় হোক। এজন্য আমরা ময়নাতদন্ত করে থাকি। ওই রিপোর্ট দেখেই বলতে পারবো কেন তার মৃত্যু হয়েছে। প্রয়োজনে আমরা তদন্ত কমিটি করবো।”
এদিকে মুশতাক আহমেদের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ২৩শে ফেব্রুয়ারি সিএমএম আদালতে হাজিরা দিতে আসা সুস্থ মানুষটি ২৫ তারিখ মারা যাবে তা অবিশ্বাস্য।
তিনি নিরপেক্ষ কমিটির মাধ্যমে এর স্বাধীন তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
একই মামলায় গ্রেফতার কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরের ওপর নির্মম নির্যাতন করা হচ্ছে বলেও তিনি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেন।