দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর অবশেষে যুক্তরাজ্যের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন মার্কিন গোপন দলিল ফাঁস করে সাড়া ফেলে দেওয়া ওয়েবসাইট উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ।
গত সোমবার তাকে মুক্তি দিয়েছে যুক্তরাজ্য।
নিজের অপরাধ স্বীকার করার বিষয়ে মি. অ্যাসাঞ্জ সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে সমঝোতা চুক্তি করেছেন, সেটির ধারাবাহিকতাতেই তাকে ছেড়ে দিয়েছে যুক্তরাজ্য সরকার।
মি. অ্যাসাঞ্জ এখন নিজের দেশ অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাবেন বলে যুক্তরাজ্যের বিচার বিভাগের একটি চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের পুলিশ ৫২ বছর বয়সী মি. অ্যাসাঞ্জকে ২০১৯ সালের গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি মার্কিন প্রতিরক্ষা বিষয়ক গোপন তথ্য সংগ্রহ এবং প্রকাশের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত।
গত কয়েক বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুক্তি দিয়ে আসছে যে, মি. অ্যাসাঞ্জের প্রতিষ্ঠান উইকিলিকস ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের বিষয়ে এমন কিছু তথ্য প্রকাশ করেছে, যা অনেক মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে।
প্রসঙ্গতঃ, ২০১০ সালে ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধের বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নথি ফাঁস করে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক হৈ-চৈ ফেলে দেয় জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ প্রতিষ্ঠিত ওয়েবসাইট উইকিলিকস।
এরপর মি. অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করে যুক্তরাষ্ট্র, শুরু হয় গ্রেফতার তৎপরতা।
গ্রেফতার এড়াতে এক পর্যায়ে মি. অ্যাসাঞ্জ লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে আশ্রয়ে নেন এবং সেখানেই প্রায় সাত বছর কাটান।
২০১৯ সালে গ্রেফতার হওয়ার পর গত পাঁচ বছর যুক্তরাজ্যের কারাগারে ছিলেন মি. অ্যাসাঞ্জ। সেখান থেকেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যার্পণের বিষয়ে আইনি লড়াই চালিয়ে আসছিলেন।
সম্প্রতি মি. অ্যাসাঞ্জ মার্কিন সরকারের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী, তিনি এখন তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ স্বীকার করে নিবেন। কিন্তু তাকে নতুন করে আর কারাগারে যেতে হবে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিবিসি’র পার্টনার সিবিএসের খবরে বলা হয়েছে যে, নিজের অপরাধ স্বীকার করার জন্য মি. অ্যাসাঞ্জকে কারাগারে পাঠানো হবে না। উল্টো, এতদিন তিনি যে কারাভোগ করেছেন, সেটির জন্য ক্ষতিপূরণ পাবেন।
মি. অ্যাসাঞ্জ ইতোমধ্যেই যুক্তরাজ্যের কারাগার থেকে বের হয়েছেন বলে জানিয়েছে তার প্রতিষ্ঠান উইকিলিকস।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘এক্স’ এ নিজেদের অ্যাকাউন্টে প্রতিষ্ঠানটি লিখেছে যে, যুক্তরাজ্যের কারাগারের একটি ছোট্ট কক্ষে ১৯০১ দিন বন্দী থাকার পর সোমবার জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ছাড়া পেয়েছেন।
“(সোমবার) বিকালে তাকে স্ট্যানস্টেড বিমানবন্দরে ছেড়ে দেওয়া হয়, যেখান থেকে তিনি একটি বিমানযোগে যুক্তরাজ্য ত্যাগ করেন,” বলেছে উইকিলিকস।
মি. অ্যাসাঞ্জ এরপর অস্ট্রেলিয়া ফিরবেন বলেও জানানো হয়েছে।
এক্স অ্যাকাউন্টে মি. অ্যাসাঞ্জের একটি ভিডিও পোস্ট করেছে উইকিলিকস।
সেই ভিডিওতে জিনস ও নীল রঙের শার্ট পরা মি. অ্যাসাঞ্জ স্ট্যানস্টেড বিমানবন্দরে দেখা গেছে। তবে বিবিসির পক্ষে স্বাধীনভাবে ভিডিওটি যাচাই করে দেখা সম্ভব হয়নি।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ২০০৬ সালে উইকিলিকস নামের ওয়েবসাইট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের স্ত্রী স্টেলা মরিস অ্যাসাঞ্জ এক্স পোস্টে মি. অ্যাসাঞ্জের সমর্থকদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, সমর্থকরা বছরের পর বছর ধরে পাশে থেকেছেন বলেই মি. অ্যাসাঞ্জের মুক্তির দাবি পূরণ হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে, সেটি অনুযায়ী মি. অ্যাসাঞ্জকে দোষী সাব্যস্ত করার বিষয়টি আগামী ২৬শে জুন উত্তর মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের একটি আদালতে চূড়ান্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়ার কাছাকাছি অবস্থিত বলেই বিচারিক কার্যক্রম চালানোর জন্য প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ওই দ্বীপটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
মি. অ্যাসাঞ্জের মুক্তি এবং মামলার পরবর্তী কার্যক্রমের বিষয়ে তার আইনজীবী রিচার্ড মিলার কোনও মন্তব্য করেননি।
তবে এরআগে দীর্ঘদিন ধরে তার পক্ষের আইনজীবীরা দাবি করে আসছিলেন যে, মি. অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে করা মামলা রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
এদিকে, বার্তাসংস্থা এএফপিকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে অস্ট্রেলিয়া সরকারের একজন মুখপাত্র বলেছেন যে মামলাটি “অনেক লম্বা সময় ধরে চলছে”।
অস্ট্রেলিয়ার পক্ষ থেকে মার্কিন সরকারের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছিল যে, তারা যেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম প্রত্যাহার করেন।
এরপর গত এপ্রিলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানিয়েছেন, তিনি অস্ট্রেলিয়া সরকারের ওই অনুরোধ বিবেচনা করে দেখছেন।
৫২ বছর বয়সী মি. অ্যাসাঞ্জকে ২০১৯ সালের গ্রেফতার করে যুক্তরাজ্যের পুলিশ
এ ঘটনার পরের মাসেই যুক্তরাজ্যের আদালত রায় দেয় যে মি. অ্যাসাঞ্জ চাইলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের বিরুদ্ধে নতুন একটি আপিল আবেদন করতে পারেন।
এই রায়ের পর মি. অ্যাসাঞ্জের স্ত্রী স্টেলা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাইডেন প্রশাসনের উচিত “লজ্জাজনক এই বিচার” থেকে নিজেকে দূরে রাখা।
তথ্য ফাঁসের পর মার্কিন সরকার মি. অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে ১৮টি মামলা করেছিলেন, যেগুলোর বেশিরভাগই করা হয় দেশটির গুপ্তচরবৃত্তি বিষয়ক আইনের অধীনে।
এরপর মার্কিন সরকারের কৌঁসুলিরা চেয়েছিলেন, প্রতিটি মামলার জন্য আলাদা বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করে মি. অ্যাসাঞ্জকে শাস্তি দিতে।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ২০০৬ সালে উইকিলিকস নামের ওয়েবসাইট প্রতিষ্ঠা করেন।
মার্কিন সরকারের দাবি অনুযায়ী, এই ওয়েবসাইটটি তাদের এক কোটিরও বেশি গোপন নথি প্রকাশ করেছে, যা দেশটির সরকারি গোপন তথ্য ফাঁসের সবচেয়ে বড় ঘটনা বলে জানানো হয়।
উইকিলিকস ২০১০ সালে মার্কিন সামরিক বাহিনীর একটি ভিডিও প্রকাশ করেছিল।
ওই ভিডিওতে ইরাকের বাগদাদে রয়টার্সের দুই সাংবাদিকসহ এক ডজনেরও বেশি ইরাকি বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করা করতে দেখা যায়।
এ ঘটনার জেরে মি. অ্যাসাঞ্জের অন্যতম সহযোগী মার্কিন সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষক চেলসি ম্যানিংকে ৩৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
অন্যদিকে, তথ্য ফাঁসের অভিযোগে মার্কিন সরকারের মামলা ছাড়াও সুইডেনেও মি. অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের পৃথক অভিযোগ তোলা হয়।
সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন মি. অ্যাসাঞ্জ।
মূলতঃ সুইডেনে মামলা হওয়ার পরেই মি. অ্যাসাঞ্জ ইকুয়েডরের লন্ডন দূতাবাসে সাত বছর লুকিয়ে ছিলেন।
কারণ তিনি আশঙ্কা করছিলেন যে সুইডেন তাকে গ্রেফতার করে মার্কিন সরকারের হাতে তুলে দিতে পারে।
পরে তিনি লন্ডন পুলিশের কাছে ধরা দেন।
তথ্য ফাঁসের পর দীর্ঘস্থায়ী আইনি লড়াই চলাকালে মি. অ্যাসাঞ্জকে খুব কমই জনসমক্ষে দেখা গেছে।
কারাগারে থাকা অবস্থায় ২০২১ সালে তিনি একবার হৃদরোগেও আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে জানা যায়।