শাল্লা থানা’র এসআই এর উপর হামলা করিয়েছিলেন ওসি

  • যুবলীগ নেতা-ওসি’র মোবাইল কথোপকথনের অডিও ফাঁস!

“অপু দা! জি ভাই, কোন জায়গায় আছেন এখন? আমি এই যে রওনা দিছি, ‘কথা কইলাইন (বলেন) তাইলে দাদার সাথে। আদাব দাদা, হ্যাঁ আপনি যেটা বলছিলেন, ওই যে শাহিদ আলীর (শাল্লা সদরে অবস্থিত শাহিদ আলী উচ্চ বিদ্যালয়) পিছে আপনার দারোগারে মন-ইচ্ছামতো দিছি। হুম। দুজন লোক আসায় বাইচ্ছা গেছে। নাইলে জানে শেষ করে দিতাম। আমরার দিকে একটু খেয়াল করইন যে, আমরার যেন কোনো সমস্যা না হয়।”

কোনো সিনেমার ডায়লগ নয় এটি। সুনামগঞ্জের শাল্লা থানার এসআই শাহ আলীকে হত্যাচেষ্টার পর ঘটনার নায়ক ওসি নুরে আলম ও ঘটনার প্রধান আসামি যুবলীগ নেতা অরিন্দম চৌধুরী অপু ও তার সহযোগীর সাথে মোবাইলে ২৮ সেকেন্ডের অডিও কলের আলাপ এটি। অডিও ক্লিপের বক্তব্য অনুযায়ী ওসি নুরে আলমের নির্দেশেই এসআই শাহ আলীকে হত্যাচেষ্টায় এ হামলার ঘটনাটি ঘটে। তবে এই ব্যাপারটি এখনো রহস্যাবৃত্ত। নিরপেক্ষ তদন্ত করলে এর সত্যতা বের হবে বলে মনে করেন শাল্লার সচেতন মহল। এ নিয়ে সর্বত্র শুরু হয়েছে তোলপাড়। অডিও রেকর্ড ফাঁসের ঘটনায় সিলেটের ডিআইজি অফিসের পুলিশ সুপার জেদান আল মুসার নেতৃত্বে দুই সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ফাঁস হওয়া অডিওতে এসআই শাহ আলীকে প্রাণে মারার ইচ্ছা ছিল বলেও হামলাকারীদের বলতে শোনা যায়। ঘটনার সময় হঠাৎ করেই দুজন লোক আসায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান ওই পুলিশ কর্মকর্তা। ফাঁস হওয়া ২৮ সেকেন্ডের অডিও ক্লিপে শাল্লা থানার ওসি নুরে আলমের সাথে কথা বলার সময় ঘটনা নিয়ে যুবলীগ নেতা তৃপ্তির ঢেকুর তুলেন।

এছাড়াও আরো ৩টি অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়েছে। যেগুলোতে যুবলীগ নেতা কর্তৃক ওসি নুরে আলমকে টাকা দেয়ার কথাও শোনা যায়। একটি অডিও ক্লিপে শোনা যায়, যুবলীগ নেতা অপু ওসিকে বলছেন, ‘ভাই কিছু খরচ পাঠাইছলাম পাইছইননি? (কিছু টাকা পাঠিয়েছিলাম পেয়েছেন)’ ওসি সম্মতিসূচক প্রতিউত্তর দিলে অপু ওসিকে বলেন, ‘ভাই কালকে থানায় আপনার জন্য মিষ্টি নিয়ে আসবো।’

এদিকে কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতার সাথেও অপুর মোবাইলে কথোপকথনের দুটি অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়েছে। অডিও ক্লিপে অপুকে ওই কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা স্থানীয় রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কিত বিভিন্ন নির্দেশনা দিতে শোনা যায়।

এছাড়া ওসির সাথে মোবাইলে কথোপকথনের বিষয়টি অপুকে অবহিত করেন তিনি।

জানা যায়, সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লায় গত ১২ জুলাই দিবাগত রাতে বিভিন্ন অপকর্মের হোতা যুবলীগ নেতা অপু বাহিনীর সন্ত্রাসী হামলায় পুলিশের এসআই শাহ আলী গুরুতর আহত হন। রাতের আঁধারে শাল্লা থানা সংলগ্ন রাস্তায় এ ঘটনা ঘটে। এসআই শাহ আলী সোমবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে থানা থেকে বের হয়ে বাসায় যাওয়ার সময় যুবলীগ নেতা অরিন্দম চৌধুরী অপুর নেতৃত্বে তার বাহিনীর ৭ থেকে ৮ জন লোক অতর্কিত হামলা চালায়। হামলায় শাহ আলী গুরুতর আহত হয়ে মাটিতে পড়ে চিৎকার করতে থাকেন। তার চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজনসহ থানার অন্য পুলিশ সদস্যরা এসে আহত এসআইকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। তবে ঘটনার সময় ওসি নুরে আলম শাল্লা থানা এলাকায় ছিলেন না। পর রাতেই অভিযান চালিয়ে শাল্লা থানা পুলিশ যুবলীগ নেতা নাইন্দা গ্রামের অরিন্দম চৌধুরী অপু, ঘুঙ্গিয়ারগাঁও গ্রামের রতন দাসকে গ্রেফতার করে। এ ঘটনায় থানা পুলিশ অপুসহ তার বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে শাল্লা থানায় পৃথক মামলা দায়ের করে। গত ৮ আগস্ট সুনামগঞ্জ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান যুবলীগ নেতা অপু।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সাম্প্রদায়িকতাকে পূঁজি করে যুবলীগ নেতা অপু বাহিনী এলাকায় বিভিন্ন অপকর্ম চালিয়ে আসছে। সম্প্রতি শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে হিন্দুদের বাড়িতে হামলাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার চেষ্টায় মেতে ওঠে অপু বাহিনী। বেপরোয়া এ বাহিনীর বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলে সাম্প্রদায়িকতার ধোঁয়া তুলে করা হয় হয়রানি। ফলে তাদের অত্যাচার নিরবে সহ্য করছে শাল্লার মানুষ। যুবলীগ নেতা অপু এর আগেও তার বাহিনী নিয়ে শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার উপর হামলা করে। ওই ঘটনার মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি ছিলেন অপু। দলীয় প্রভাব ও সাম্প্রদায়িকতাকে পূঁজি করে তিনি ক্রমশই বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।

হামলা ও অডিও ক্লিপের বিষয়ে শাল্লা থানা থেকে সদ্য বদলীকৃত এসআই শাহ আলী বলেন, অডিও ক্লিপ ফাঁস হওয়ার বিষয়টি শুনেছি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কর্তৃক এমনটি
হয়ে থাকলে তা খুবই দুঃখজনক।

ওসি নুরে আলমের সাথে বিরোধ ছিল কি-না জানতে চাইলে শাহ আলী বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কিত গোপনীয় প্রতিবেদন পাঠাতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা আসে। আমি থানা এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি ও গণজরিপ করে ড. জয়া সেনগুপ্তা এমপি স্যারকে অগ্রাধিকার দিয়ে এবং উপজেলা চেয়ারম্যান আল আমিন চৌধুরী স্যারকে দ্বিতীয় অবস্থান দেখিয়ে প্রতিবেদন প্রস্তুত করি। কিন্তু ওসি সাহেব আমাকে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা ব্যারিস্টার অনুকূল তালুকদার ডাল্টনের নাম সবার আগে রেখে প্রতিবেদন দিতে বলেন। আমি এমন প্রতিবেদন দিতে রাজী হইনি। এ নিয়ে ওসি সাহেব আমার উপর মনক্ষুণ্ণ ছিলেন।

যুবলীগ নেতার সাথে অডিও ক্লিপের বিষয়ে জানতে চাইলে শাল্লা থানার ওসি নুরে আলম বলেন, আমি কিছুই জানি না। এসব মিথ্যা। আমার কারো সাথে কোনো কথা হয়নি।

এ দিকে আলোচিত হামলার ঘটনার অডিও রেকর্ড ফাঁসের ঘটনায় সিলেটের ডিআইজি অফিসের পুলিশ সুপার জেদান আল মুসার নেতৃত্বে দুই সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অপর সদস্য হলেন- সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ছাতক সার্কেল) বিল্লাল হোসেন। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি শাল্লা থানায় এসে ঘটনার তদন্তে রয়েছেন বলে নয়া দিগন্তকে নিশ্চিত করেছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দিরাই সার্কেল) আবু সুফিয়ান।

সূত্র: নয়া দিগন্ত

error: