ভোটকেন্দ্রের ভেতর দাঁড়িয়ে অনিয়ম ও কারচুপির ঘটনা প্রত্যক্ষ করছিলেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক জহির রায়হান। একপর্যায়ে নিজের মুঠোফোনে কিছু ছবিও তোলেন। জহির ছবি তুলেছেন দেখে ক্ষিপ্ত হন ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আজিজুল হক। তিনি (জহির রায়হান) কেন কেন্দ্রের ভেতর ঢুকলেন, কার অনুমতি নিয়েছেন, কেন ছবি তুলছেন—এমন প্রশ্নে জর্জরিত করেন সাংবাদিককে। একপর্যায়ে জোর করে জহিরের মুঠোফোন নিয়ে নিতে উদ্যত হন তিনি। গায়েও হাত তোলেন। হাতাহাতির একপর্যায়ে জহিরের ডান হাত রক্তাক্ত হয়। তখন মুঠোফোনটি আর নিজের কাছে রাখতে পারেননি তিনি। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সেটি নিয়ে ওই কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক কর্মীর হাতে দেন। ওই কর্মী তখন মুঠোফোন থেকে সব ছবি মুছে (ডিলিট) দেন। এরপর প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মুঠোফোনটি তুলে দেন একজন পুলিশ কর্মকর্তার হাতে।
এই ঘটনা দুপুর ১২টার দিকের। ঘটনাস্থল ঢাকার ধামরাই পৌরসভার হুজেরিটোলা এলাকার কলেজিয়েট স্কুল। রক্তাক্ত জহিরকে সেখান থেকে হাসপাতালে নিয়ে যান প্রথম আলোর সাভারের নিজস্ব প্রতিবেদক অরূপ রায়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর জহির এখন ধামরাইয়ে অবস্থান করছেন। পুলিশের কাছ থেকে মুঠোফোনটিও ফেরত পেয়েছেন।
ঘটনার শুরুটা দুপুর পৌনে ১২টার দিকে। প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক জহির রায়হান ও অরূপ রায় ভোটের সংবাদ সংগ্রহের জন্য ওই ভোটকেন্দ্রে যান। কেন্দ্রের বাইরে দায়িত্ব পালনরত পুলিশের সঙ্গে কথা বলেই ভোটকেন্দ্রের ভেতরে ঢোকেন।
নির্বাচন কমিশনের বিধি অনুযায়ী সাংবাদিকদের জন্য নির্ধারিত কার্ড নিয়ে ভোটকেন্দ্রের ভেতর ঢুকতে কোনো বাধা নেই। শুধু ভোট দানের গোপন কক্ষ ছাড়া সাংবাদিকেরা সংবাদ সংগ্রহের জন্য কেন্দ্র ঘুরে দেখতে পারেন। ছবিও তুলতে পারেন।
ভেতরে ঢুকেই এই কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ নিয়ে নানা অনিয়ম দেখতে পান তাঁরা।
ভোটাররাই এসে অভিযোগ করেন, ভোট দিতে দেরি করানো হচ্ছে। মেয়র প্রার্থীর ভোট অন্যরা দিয়ে দিচ্ছেন। অরূপ রায়ের সঙ্গে যখন ভোটাররা এ ধরনের কথা বলছেন, তখন সেখানে এসে হাজির হন ধামরাইয়ের উপজেলা প্রকৌশলী ও এই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আজিজুল হক।
অরূপ রায়ের সঙ্গে আজিজুল হকের কথোপকথনটা এমন:
আজিজুল: আপনি কে?
অরূপ: সাংবাদিক।
আজিজুল: এখানে ঢুকেছেন কেন?
অরূপ: খবর সংগ্রহের জন্য।
আজিজুল: ঢোকার অনুমতি কে দিয়েছে?
অরূপ: নির্বাচন কমিশন।
আজিজুল: আপনি কেন্দ্রের বাইরে থাকেন।
অরূপ: কিন্তু আমার তো এখানে আসার অনুমতি আছে?
আজিজুল: আমি অনুমতি না দিলে কোনো অনুমতি নেই।
কথাবার্তার এই পর্যায়ে ভোটাররা প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছে নানা অভিযোগ দেওয়া শুরু করেন। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সেখান থেকে দ্রুত সরে আসেন। এ সময় দেখতে পান, ভোটকক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে একজন (জহির) ছবি তুলছেন। সেখানে গিয়ে চড়াও হন তিনি।
কেন কেন্দ্রের ভেতর ছবি তুলছেন, তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ সময় আজিজুল বলেন, ভোটের অনিয়ম বা অন্য ছবি ভোটকেন্দ্রের বাইরে তুলতে হবে। ভোটকেন্দ্রের ভেতর কোনো ছবি তোলা যাবে না। এরপরই মুঠোফোন নিতে হাতাহাতি শুরু করেন তিনি। কিন্তু না পেরে সাংবাদিকের ওপর চড়াও হন। একপর্যায়ে জহিরের হাত কেটে যায়। তখন মুঠোফোন নিয়ে নেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা। মুঠোফোনটি স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মীর (নৌকা প্রতীকের ব্যাজ পরা) হাতে দিয়ে চেক করতে বলেন। পরে ওই কর্মী মুঠোফোন থেকে ছবি ডিলিট করে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছে ফেরত দেন।
এরপর তিনি মুঠোফোনটি কেন্দ্রের দায়িত্ব থাকা পুলিশ কর্মকর্তা আসিফের হাতে দেন।
বিষয়টি রিটার্নিং কর্মকর্তা মুনীর হোসাইনকে জানালে তিনি এ নিয়ে কিছু মনে না করার জন্য সাংবাদিকের প্রতি অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, গোপন কক্ষের অনিয়মের ছবি তোলা যায় না। বাইরে থেকে ছবি তোলা যাবে।
জহির রায়হান বলেন, তিনি গোপন কক্ষের ভেতরের কোনো ছবি তোলেননি। ওই কেন্দ্রে মেয়র প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার ইভিএম মেশিনটি বাইরে এনে রাখা হয়েছিল।
ভোটাররা কাউন্সিলর প্রার্থীদের ভোট গোপন কক্ষেই দিয়েছেন। কিন্তু মেয়র প্রার্থীর ক্ষেত্রে তাঁদের ভোটটি আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকার ব্যাজ পরা ব্যক্তিরা দিয়ে দিচ্ছিলেন।
অরূপ রায় জানান, পুরো বিষয়টি তাঁরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সামিউল হক ও স্থানীয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দীপক চন্দ্র সাহাকে জানিয়েছেন।
ধামরাইয়ে মেয়র পদে তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাঁরা হলেন আওয়ামী লীগের পৌর সভাপতি গোলাম কবির, বিএনপির পৌর সভাপতি দেওয়ান নাজিম উদ্দিন। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলনও নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী দিয়েছে।
সুত্র: প্রথম আলো।