দু’টি ঘটনা নাড়া দিয়েছে সিলেট নগরবাসীকে। এরমধ্যে একটি হচ্ছে আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি। এরপর তাকে কুপিয়ে আহত করা। অপরটি এক ব্যবসায়ীর ৪২ লাখ টাকা ছিনতাই। সশস্ত্র ছিনতাইকারীরা প্রকাশ্য দিবালোকে অস্ত্রের মুখে ওই টাকা ছিনিয়ে নেয়। এ দুটি ঘটনাই সিলেটের সাম্প্রতিক কালের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বুঝিয়ে দেয়। এর বাইরে নগর জুড়ে রয়েছে ঝাপটাপার্টির আধিপত্য। রাত হলেই নগরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক দখলে নেয় চিহ্নিত ছিনতাইকারীরা। শীতকালে আছে ডাকাতির ভয়। এরইমধ্যে নগরের দক্ষিণ সুরমায় সশস্ত্র ডাকাতির ঘটনাও সংঘটিত হয়েছে। নগরবাসী বলছেন; আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ পুরোপুরি সক্রিয় না হওয়ায় সিলেটে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে অপরাধী চক্র। সিলেটের অপরাধ জগৎও কয়েকদিন ধরে সরব। চিহ্নিত অপরাধীরা ফের আস্থানায় ফিরতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক দলের আড়ালে থেকে তারা অপরাধ কর্মকাণ্ড সংঘটিত করছে। আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মিসবাহ সিরাজ প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর থেকে গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে ছিলেন। তবে তিনি নিজ এলাকায় বাসা বদল করে বসবাস করতেন। তার স্বজনরা জানিয়েছেন- বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে মুখোশ পরা সন্ত্রাসীরা নগরের ফাজিলচিস্তের নিজ বাসার সামনে থেকে অস্ত্রে মুখে জিম্মি করে অপহরণ করে নিয়ে যায়।
এরপর রাতে দেন-দরবারের পর ২৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়। অপহরণের সময়ই মিসবাহ সিরাজের হাত ও পায়ে উপর্যুপরি কোপানো হয়। এ ঘটনা গতকাল পর্যন্ত মিসবাহ সিরাজ কিংবা পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় অভিযোগ দেয়া হয়নি। নগর পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন- তারা ঘটনার ছায়া তদন্ত করে সত্যতা পেয়েছেন। কিন্তু অভিযোগকারী কিংবা ভিকটিমকে খুঁজে না পাওয়ায় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। পুলিশ এখনো অভিযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন- সুবিদবাজার কেন্দ্রিক অপরাধ চক্রের সদস্যরা পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে। এই চক্রে রয়েছে সব দলের অপরাধীদের অংশগ্রহণ। এ ঘটনার পর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় নগরের সুবিদবাজার, সাগরদিঘীরপাড়, বনকলাপাড়া, পাঠানটুলাসহ কয়েকটি এলাকায় অপরাধীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। প্রতিদিনই রাজনৈতিক দলের আড়ালে অপরাধীদের আড্ডা বাড়ছে। এতে করে ওই এলাকায় বেড়েছে ছিনতাইও। গত ৯ই ডিসেম্বর তিন ব্যাংক থেকে ৪২ লাখ টাকা তুলে বাসায় ফিরছিলেন ব্যবসায়ী রূপায়েল আহমদ ও তার ভাই হেলাল আহমদ। বেলা ২টার দিকে শিবগঞ্জ ফরহাদ খাঁ পুলের পাশে তাদের বহনকারী সিএনজি অটোরিকশার গতিরোধ করে টাকা ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। এ ঘটনায় ওই ব্যবসায়ীর পক্ষ থেকে থানায় অভিযোগ দেয়া হলেও এখনো টাকা মেলেনি কিংবা ছিনতাইকারীদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। সিলেট নগরীর সোনালী ব্যাংক আম্বরখানা করপোরেট শাখা থেকে বিদেশি টাকা এক্সচেঞ্জ করে রিকশায় আখালিয়ার বাসায় ফিরছিলেন এক নারী। মোটরসাইকেলে কয়েকজন যুবক তাকে অনুসরণ করে। ব্যাংক থেকে কয়েকশ’ গজ যাওয়ার পর দর্শন দেউড়ি রাস্তার মুখে তারা তার টাকা ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে। সিএনজি অটোরিকশার কয়েকজন চালকের সহায়তায় ওই নারী রক্ষা পান। ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। বৃহস্পতিবার দুপুরে ছাতক উপজেলার কুর্শিগ্রাম থেকে কয়েকজন নগরীর কেওয়াপাড়ার শাহীন আহমদের বাসায় বেড়াতে আসেন। আত্মীয়দের নিয়ে ব্যস্ত থাকার সুযোগে জানালা দিয়ে বিছানার ওপর থাকা মোবাইল ফোন ও ব্যানিটি ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যায় চোর। গত ৪ঠা নভেম্বর ভোরে ঢাকা থেকে সিলেট বাস টার্মিনালে নেমে কিনব্রিজ যাওয়ার সময় ঝাপটা পার্টির কবলে পড়েন ক্ষুদ্র ব্যসায়ী সাজিদুল ইসলাম।
তিনি মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় দুই যুবক ছোঁ মেরে ফোন নিয়ে পালিয়ে যায়। উপশহর এলাকায় একটি খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায়ও পৃথক মামলা করা হয়। একই সময়ে রায়নগর থেকে মোটরসাইকেল চুরি, উপশহরের দুটি বাসা থেকে দুটি আইফোন চুরি, গত সোমবার সোবহানীঘাটে ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুস সামাদসহ ভুক্তভোগীরা থানায় পৃথক জিডি করেন। পুরাতন মেডিকেল কোয়ার্টারের একটি বাসায় ও দক্ষিণ সুরমার মোল্লারগাঁও ইউনিয়নের বেটুয়ারমুখ গ্রামে সাবেক ইউপি সদস্য ইলাছ মিয়ার বাড়িতে পৃথক ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও মামলা হয়েছে একটি। কিন্তু সম্প্রতি ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্মচারী মাহমুদা, গৃহিণী রানী রায়, গৃহকর্তা শাহিন আহমদসহ অনেকে কোনো অভিযোগ করেননি। এভাবে প্রতিদিনই নগরীর কোথাও না কোথাও ছিনতাই, চুরি ও ঝাপটা পার্টির কবলে পড়ছেন বিভিন্ন পেশার লোকজন। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি পণ্যবাহী ট্রাক ছিনতাই ও ডাকাতির একাধিক ঘটনাও ঘটেছে। এসএমপি’র তথ্যমতে, নভেম্বরে ১৯টি চুরি, আটটি ছিনতাই ও একটি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এর আগের মাস অক্টোবরে একটি ডাকাতি, পাঁচটি ছিনতাই ও ১২টি চুরির ঘটনা ঘটে। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) মো. সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন- অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ আগের চেয়ে বেশি সক্রিয় রয়েছে। বিশেষ করে ছিনতাই প্রবণ এলাকায় টহল জোরদার করা হয়েছে। রাতের বেলা সিনিয়র কর্মকর্তারা মাঠে থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। তিনি জানিয়েছেন- কেউ যদি ব্যাংক থেকে বেশি পরিমাণ টাকা তোলেন তাহলে পুলিশকে জানালে নিরাপত্তা দেয়া হবে। এ ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকেও জানিয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। আর শীতকালে ডাকাতি রোধে নগরের সব এলাকায়ই টহল জোরদার করা হয়েছে।
সূত্র: মানবজমিন ।