১৯ বছরে ৩১ বার আগুনে পুড়েছে সুন্দরবন

চোরা শিকারি দমনে সুন্দরবনজুড়ে চলছে রেড এলার্ট। বন বিভাগের সর্বত্র কঠোর সতর্কতা রয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে ৮ ফেব্রুয়ারি পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর টহল ফাঁড়ির কাছে ২৭ নম্বর কম্পার্টমেন্টের বনে আগুন লাগে। এতে প্রায় ২০০ বর্গ মিটার (প্রায় ৪ শতক) বনভূমি পুড়ে যায়। বন বিভাগ বলছে, বনকর্মীদের সতর্কতার কারণে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছে সুন্দরবন। তবে আগুন লাগার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। গত ১৯ বছরে ১০০ একর বনভূমি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বনবিভাগের বিভিন্ন সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

সুন্দরবনে সর্বশেষ আগুন লাগে গতকাল সোমবার পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর টহল ফাঁড়ির কাছে। ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট এসে স্থানীয় লোকজন ও বনকর্মীদের সহায়তায় আগুন নেভায়। তবে বনের গাছের নিচে জমে থাকা পাতার স্তূপের কারণে পুরো আগুন নিভে যেতে সময় লাগে।
আগুন নেভাতে আসা শরণখোলা ফায়ার স্টেশনের কর্মকর্তা আগুন এম আব্দুল ওদুদ আগুন লাগার কারণ তাৎক্ষণিক নিশ্চিত করতে পারেননি।
তবে স্থানীয়দের বরাত দিয়ে ধানসাগর ইউপি সদস্য হুমায়ুন করিম সুমন জানান, কিছু তরুণ বনের ভেতরে ঢুকে ধূমপান করেছিল। তারা অসাবধানতাবশত সিগারেটের অবশিষ্টাংশ বনে ছুড়ে ফেলে বের হয়ে যাওয়ার পর এ আগুন লাগার ঘটনা ঘটে।

সুন্দরবনে আগুন
বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, বনবিভাগের প্রচষ্টোয় সুন্দরবন বড় ধরনের ক্ষতি হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। পরবর্তীতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘরে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কঠোর নজরদারি রাখতে বলা হয়েছে। আগুনের এ ঘটনায় চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মোঃ এনামুল হককে প্রধান করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন চাঁদপাই রেঞ্জের স্টেশন কর্মকর্তা অসিত কুমার রায় ও লন চাঁদপাই রেঞ্জের ফরেস্ট রেঞ্জার ওবায়দুর রহমান। তদন্ত কমিটিকে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
তবে এই আগুন কি নিছকই দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা? স্থানীয়রা এজন্য সিগারটের অবশিষ্টাংশ ফেলে রাখাকে দায়ী করলেও সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. ফরিদুল ইসলামের সন্দেহ এটি নাশকতার আগুনও হতে পারে। তার বক্তব্য অনুযায়ী, ‘সোমবারের ঘটনা নাশকতাও হতে পারে। যেসব এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে সেসব এলাকার কিছু অসাধু জেলে মাছ ধরার সুবিধার জন্য জায়গা খালি করতে আগুন লাগায়।’
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগীয় কার্যালয়ের (বাগেরহাট) মো. হারিস বনে আগুন লাগার বেশ কিছু তথ্য দিয়েছেন। এছাড়াও আরও তথ্য পাওয়া গেছে অন্য বনকর্মকর্তা ও বিভিন্ন সূত্রে।
তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনে ১৯ বছরে ৩১ বার আগুন লেগে পুড়ে গেছে প্রায় ১০০ একর বনভূমি। গত ৮ ফেব্রুয়ারি আগুনে পুড়েছে ধানসাগর টহল ফাঁড়ি এলাকার প্রায় ৪ শতক বনভুমি। এর আগে ২০১৭ সালের ২৬ মে পূর্ব সুন্দরবনে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলী ফরেস্ট ক্যাম্পের আওতাধীন আবদুল্লাহর ছিলায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রায় পাঁচ একর বনভূমির ছোট গাছপালা,লতাগুল্ম পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
সুন্দরবনে আগুন লাগার উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো হলো ২০০২ সালের ২২ মার্চ সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জে কটকাতে পুড়ে যায় প্রায় ১ একর ছন বন। এরপর ২০০৪ সালের ২৫ মার্চ চাঁদপাই রেঞ্জের নাংলি ক্যাম্পসংলগ্ন এলাকায় পুড়ে যায় ৩ একর বনভূমি। একই বছরের ২৭ ডিসেম্বর আড়ুয়াবেড় এলাকায় আগুনে পুড়ে যায় প্রায় ৯ শতক ছন বন। ২০০৫ সালের ৮ এপ্রিল ধানসাগর স্টেশনের অধীন কদলতেজী এলাকায় পুড়ে যায় প্রায় ৩ একর বন। এ ঘটনার ৫ দিন পর একই এলাকার তুলাতলায় পুড়ে যায় ৪.৫ একর বনভূমি। এরপর ২০০৬ সালের ১৯ মার্চ শরণখোলা রেঞ্জের তেরাবেকা এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর কিছুদিন পর ১১ এপ্রিল চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়ায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর এক দিন পর কলমতেজির টহলফাঁড়ির খুটাবাড়িয়া এলাকার দেড় একর, ১ মে নাংলির পঁচাকুড়ালিয়া এলাকার ৫০ শতক, ৩ দিন পর ধানসাগর স্টেশনসংলগ্ন এলাকায় আগুন লেগে পুড়ে যায় ২.৫ একর বনভূমি। ২০০৭ সালে ৩ দফায় (১৫ জানুয়ারি, ১৯ মার্চ ও ২৮ মার্চ) একই এলাকার প্রায় ১৫ একর বনভূমি পুড়ে যায়। ২০১০ সালের ২০ মার্চ ধানসাগর স্টেশনের গুলিশাখালী এলাকায় প্রায় ৫ একর বন পুড়ে যায়। পরে ২০১১ সালের মার্চ মাসে দুই দফা বনে আগুন লাগে। এতে প্রায় সাড়ে ৩ একর বন পুড়ে যায়। প্রায় ১০ একর বনভূমি পুড়ে যায় ২০১৪ সালের ২৫ মার্চ তারিখের অগ্নিকাণ্ডে। ২০১৬ সালের ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলি ফরেস্ট ক্যাম্পসংলগ্ন এলাকার আগুন লাগে। ১৩ এপ্রিল একই এলাকায় ফের আগুন লাগে। পুড়ে যায় ৮.৫ একর বন। ১৮ এপ্রিল আব্দুল্লাহর ছিলায় এবং ওই বছরের ২৭ এপ্রিল তুলতলার বিলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ২০১৭ সালের ২৬ মে পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলী ফরেষ্ট ক্যাম্পের আওতাধীন মাদ্রাসারছিলা এলাকায় আগুন লাগে।

এদিকে নানা সময়ে আগুনের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য ছিলেন এমন দু’জন বন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কমিটি বনের অভ্যন্তরে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধকল্পে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি দু’ধরনের সুপারিশমালা পেশ করেছিল। সুপারিশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বন-সংলগ্ন লোকালয়ের লোকজনের মাঝে আগুন বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি, অগ্নিকাণ্ডের পর তা নিয়ন্ত্রণ বা নেভাতে বন বিভাগের লোকবল বৃদ্ধি, বন বিভাগের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপক ইউনিট গঠন, বন-সংলগ্ন ভরাট হয়ে যাওয়া বিভিন্ন নদী ও খাল খননের মাধ্যমে গভীরতা সৃষ্টি প্রভৃতি।

ওই কর্মকর্তারা আরও বলেন, সুপারিশের অধিকাংশই দীর্ঘদিনে বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে বনাঞ্চলে বারবার আগুনের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া আগুন লাগার পর তা নেভাতেও বনকর্মীদের চরম ভোগান্তি আর দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

error: