করোনাকালে ব্যাংকিং লেনদেনে বড় পরিবর্তন এসেছে। ব্যাংকগুলো তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর পাশাপাশি সব ধরনের লেনদেন সহজ করেছে। সহজ বলতে, ব্যাংক লেনদেন করতে এখন আর জেলা শহর বা উপজেলা শহরে যাওয়ার দরকার হচ্ছে না। ঘরে বসেই লেনদেন করা যাচ্ছে ব্যাংক থেকে ব্যাংকে। অ্যাকাউন্টও খোলা যাচ্ছে ঘরে বসেই। ঘরে বসেই সরকারি খাতের সবচেয়ে বেশি শাখার সোনালী ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বেশি শাখার ইসলামী ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট খোলা যাচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের এই বড় দুটি প্রতিষ্ঠান লেনদেন সহজ করতে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ দিয়েছে। অ্যাপের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খোলা ছাড়াও বিকাশের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের লেনদেন করা যাচ্ছে। অর্থাৎ সোনালী ব্যাংকের আড়াই কোটি গ্রাহক এখন তাৎক্ষণিক বিকাশ অ্যাকাউন্টে টাকা আনতে পারছেন এবং বিকাশ থেকে সোনালী ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জমাও দিতে পারছেন।
একইভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে বিকাশ অ্যাকাউন্টে টাকা আনা এবং বিকাশ অ্যাকাউন্ট থেকে অগ্রণী ব্যাংকে হিসাবে টাকা জমা করা যাচ্ছে। অন্যদিকে ইসলামী ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে মোবাইল ব্যাংক বলে খ্যাত এমক্যাশ অ্যাকাউন্টে এবং এমক্যাশ অ্যাকাউন্ট থেকে ইসলামী ব্যাংকের যেকোনও অ্যাকাউন্টে টাকা আনা ও জমা করা যাচ্ছে। এমক্যাশ অ্যাকাউন্ট থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স, সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঘরে বসেই বেতন নিচ্ছেন অনেকে। এছাড়া সেলফিন অ্যাপস দিয়ে ইসলামী ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট খোলা যাচ্ছে। চেকবিহীন লেনদেন বাড়াতে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে ব্যাংকটি। গ্রামগঞ্জের বাজারগুলোতে ইসলামী ব্যাংকের প্রায় আড়াই হাজার এজেন্ট শাখার অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই এজেন্ট শাখাগুলোতে একটি সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলে ফিঙ্গার দিয়ে বেতন-ভাতা নিচ্ছেন শত শত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। শুধু তা-ই নয়, যেখানে ইসলামী ব্যাংকের এজেন্ট শাখা রয়েছে, সেখানে মূল ব্যাংকের সব ধরনের সেবা মিলছে। লাখ লাখ টাকা উঠাতেও শহরের কোনও ব্যাংকে যাওয়া লাগছে না। যেকোনও পরিমাণ টাকা জমা করতে এবং যেকোনও ব্যাংকে যে কোনও পরিমাণ টাকা পাঠানোর জন্যও জেলা বা উপজেলা শহরে যেতে হচ্ছে না। লাখ লাখ টাকার ইএফটি, আরটিজিএস সবই হচ্ছে গ্রামগঞ্জের বাজারে অবস্থিত ইসলামী ব্যাংকের এজেন্ট আউটলেট থেকেই।
এ প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, প্রতিযোগিতায় সবাই এগিয়ে থাকতে চায়। এ কারণে সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকই তাদের গ্রাহকদের সেবার মান বাড়াতে সচেষ্ট। মোবাইলে লেনদেনকে ডিজিটাল বাংলাদেশের অন্যতম একটি সুযোগ বলে মনে করেন তিনি। তিনি উল্লেখ করেন, প্রযুক্তির ব্যবহারে যারা এগিয়ে থাকবে, তাদের গ্রাহকরাও এগিয়ে থাকবে। তারা বাজারে জনপ্রিয় হবে।
এদিকে সেলফিন ও এমক্যাশকে জনপ্রিয় ও সহজলভ্য করতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। এ ব্যাংকটির কার্ড ব্যবহার করা যায় বিশ্বের যেকোনও দেশে। শুধু তা-ই নয়, নগদ টাকা জমা দিতেও এখন আর যেতে হয় না ব্যাংকে। ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ইসলামী ব্যাংকের সেলফিন একটি স্মার্ট ডিজিটাল ব্যাংকিং অ্যাপ। যেকোনও ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট, কার্ড ও এমক্যাশ নম্বরে সরাসরি টাকা পাঠানো যায় সেলফিন থেকে। টাকা নেওয়া যাচ্ছে বিকাশ, নগদ ও রকেটেও। আর যেকোনও ব্যাংকের ভিসা বা মাস্টারকার্ড, ইসলামী ব্যাংকের সেভিংস অ্যাকাউন্ট ও এমক্যাশ থেকে টাকা আনা যাচ্ছে সেলফিনে। এতে রয়েছে ভিসা সুবিধা সংযুক্ত একটি ভার্চুয়াল ডেবিট কার্ড। এর মাধ্যমে দেশি-বিদেশি যেকোনও সাইটে ই-কমার্সের পেমেন্ট দেওয়া যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল মাওলা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ব্যাংকিং খাতের ডিজিটাল প্রোডাক্ট ও সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সর্ববৃহৎ ইসলামী ব্যাংক নেতৃত্বের ভূমিকায় আছে। ইসলামী ব্যাংকের সেলফিন আই ব্যাংকিং ও ইসলামী ব্যাংকের এজেন্ট আউটলেট সবই আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। সেলফিন অ্যাপস সব ধরনের লেনদেনকে আরও সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্য করেছে।
অবশ্য কেবল মোবাইল ব্যাংকিং (এমএফএস) মাত্র তিন বছরে লেনদেন দ্বিগুণ হয়ে গেছে। একইভাবে গ্রাহকও বেড়েছে দ্বিগুণ হারেই। এর ফলে এখন দৈনিক প্রায় ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে বিকাশ, রকেটের মতো সেবার মাধ্যমে। তিন বছর আগেও দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১ হাজার কোটি টাকার মধ্যে। এ খাতের আরেক প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’-কে হিসাবে ধরলে দৈনিক লেনদেন আড়াই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
এদিকে মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নগদ ও বিকাশের জোয়ারে কিছুটা থমকে গেছে রকেট ও শিওরক্যাশ। যদিও দেশে ডাচবাংলাই প্রথম ব্যাংক, যাদের হাত ধরে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বা এমএফএস সেবা চালু করে। বর্তমানে রকেট শুধু টাকা জমা ও উত্তোলনের মধ্যে আটকে নেই। বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্য বিক্রির টাকা সংগ্রহ হয় রকেটের মাধ্যমে, আবার অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের বেতন ভাতাও দেওয়া হয়। সরকারি ভাতা, বৃত্তির টাকা, পরিষেবা বিল পরিশোধ সুবিধাও রয়েছে। ২০১১ সালের মার্চে ডাচবাংলা ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে। ২০১৬ সালে এ সেবার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় রকেট, যা এখন টাকার রকেট নামে পরিচিত। এছাড়া ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিকাশের পাশাপাশি মাই ক্যাশ, ইউক্যাশ, শিওর ক্যাশসহ নানা নামে ১৬টি ব্যাংক এ ধরনের সেবা দিচ্ছে। এখন ট্রাস্ট ব্যাংক ও আজিয়াটা ডিজিটাল মিলে আনছে নতুন সেবা ‘ট্যাপ’। বর্তমানে বিকাশ থেকে এক হাজার টাকা তুলতে একজন গ্রাহককে খরচ করতে হয় সাড়ে ১৮ টাকা। নগদ থেকে উঠাতে লাগে সাড়ে ১১ টাকার মতো। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য-উপাত্ত বলছে, গত ডিসেম্বরের শেষে এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রাহক হিসাবে ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি জমা ছিল। ডিসেম্বর শেষে এমএফএসে গ্রাহক হিসাব ছিল ৯ কোটি ৯৩ লাখ। সক্রিয় গ্রাহক ছিল ৩ কোটি ২৩ লাখ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর মাসজুড়ে এমএফএসে লেনদেন হয়েছে ৫৬ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। যদিও ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে এ লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা।
এদিকে পাল্লা দিয়ে নগদ ও বিকাশ মোবাইল লেনদেন সহজলভ্য করেছে। এরমধ্যে বিকাশের গ্রাহকরা তার প্রিয় পাঁচটি নম্বরে মাসে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত সেন্ড মানি করার সুযোগ পাচ্ছেন কোনও খরচ ছাড়াই। অন্যদিকে নগদ এখন থেকে ফ্রি সেন্ড মানি ও ক্যাশ আউট চার্জ সিঙ্গেল ডিজিট করেছে। এছাড়া নগদে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, বাড়তি চার্জ ছাড়া গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি-ইন্টারনেটের বিল বা বিমার প্রিমিয়াম প্রদান, স্বাচ্ছন্দ্যময় পেমেন্ট—এসব কারণেও মাত্র দুই বছরের যাত্রায় ‘নগদ’ হয়ে উঠেছে তিন কোটি গ্রাহকের এক বিশাল পরিবার। প্রতিদিনের লেনদেন ছাড়িয়েছে তিনশ কোটি টাকা। ডিজিটাল কেওয়াইসির মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খোলা, অ্যাকাউন্ট না থাকলেও যেকোনও নম্বরে টাকা পাঠানোর সুবিধা দিচ্ছে নগদ। নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ মিশুক বলছেন, সরকারের সব আর্থিক সেবা কার্যক্রম একের পর এক যুক্ত হচ্ছে ‘নগদ’-এর সঙ্গে। ‘নগদ’-কে ব্যবহার করেই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতা বিতরণেও স্বচ্ছতা নিয়ে এসেছে। গত বছরে ১৭ লাখ মানুষকে আড়াই হাজার টাকা করে আর্থিক বিতরণ করা হয় ‘নগদ’-এর মাধ্যমে।
এদিকে বিকাশ গ্রাহক তার প্রিয় পাঁচটি নম্বরে মাসে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত সেন্ড মানি করার সুযোগ পাচ্ছেন কোনও খরচ ছাড়াই। ফলে ৯০ শতাংশ বিকাশ গ্রাহকেরই সেন্ড মানিতে কোনও খরচ থাকছে না। কারণ, এমএফএস লেনদেনের তথ্য-বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রায় ৯০ শতাংশ গ্রাহকই প্রতিমাসে গড়ে তিন থেকে চারটি অ্যাকাউন্টে ১৫ থেকে ২০ হাজার করে টাকা পাঠিয়ে থাকেন।
এদিকে প্রগতি সিস্টেমের সেবা শিওরক্যাশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা পরিচালনা করছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন রূপালী ব্যাংক। যার নাম রূপালী ব্যাংক শিওরক্যাশ। এর মাধ্যমে সারা দেশে বৃত্তি, ভাতা বিতরণ, ভর্তুকি প্রদানসহ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের বিভিন্ন ধরনের সেবা দেওয়া হচ্ছে।