নীতি-নির্ধাকরদের ছলচাতুরী বনাম সাংবাদিকদের অসহায়ত্ব

সিরাজুল ইসলাম কাদির

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অবদমিত করে রাখার জন্য পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে নানা চাতুর্যপূর্ণ কৌশলের আশ্রয় নেয়ার বিষয় কমবেশি সকলেই অবহিত। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রতিপক্ষকে প্রতিযোগিতার মাঠ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যে সরকার তাদের বিরুদ্ধে মামলার আশ্রয় নিয়ে কারারুদ্ধ করে রাখে। অন্তরীণ হওয়া কিংবা ‘ক্রসফায়ারের’ আশ্রয় নিয়ে চিরতরে নির্মূল করার এন্তার দৃষ্টান্ত রয়েছে এদেশে। এজন্যে এককভাবে কোনো সরকারকে দায়বদ্ধ করা যাবে না। দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের চরিত্রের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এজন্য পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহ, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের এই ধরনের রাজনীতির ঘোরতর বিরোধিতা করে থাকে। সরকার যাতে নাগরিকদের এভাবে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত না করে সে জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের প্রতিশ্রুত অর্থ সহায়তা কিংবা তৈরি পোশাক শিল্প রপ্তানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান কর রেয়াত সুবিধা বাতিল করার হুমকিও দেয়। কিন্তু তাতে অনেক সময়ই ফল পাওয়া যায় না। যুক্তরাষ্ট্র বারবার মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বাংলাদেশে মানবাধিকার ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে- এসব অভিযোগ তারা ক্রমাগতভাবে করেই যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর মানবাধিকার অনুশীলন সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রণয়ন ও প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই প্রতিবেদন তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে এবং ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস আগে থেকেই অনানুষ্ঠানিকভাবে এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় সম্পর্কে  সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের অবগত করে। দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলো এই রিপোর্ট যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে যথারীতি এই রিপোর্টকে ‘মনগড়া’, ‘একপেশে’, ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ ইত্যাদি শব্দ সংযুক্ত করে প্রতিবাদ জানানো হয়। এই প্রতিবেদনে নাগরিকদের অধিকার, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, কারখানায় শ্রমিকদের অধিকার ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরা হয়। সর্বজনীন মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক চুক্তির নিরিখে নাগরিকদের এসব অধিকার কতটা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে তা এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। ১৯৬১ সালের বৈদেশিক সহায়তা আইন এবং ১৯৭৪ সালের বাণিজ্য সংক্রান্ত আইনের আওতায় যেসব দেশ সহায়তা গ্রহণ করে এবং যেসব দেশ জাতিসংঘের সদস্য তাদের উপরই এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই প্রতিবেদন মার্কিন কংগ্রেসের কাছে পেশ করে। এসব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার পরই তা প্রকাশ করা হয়।
এ রকম একটি আঙ্গিকে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তীব্র ভাষায় বারবার প্রতিবাদ জানানো হচ্ছিল। একপর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য এদেশে সফরে আসেন। মূলত ঐ সময় দেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড এবং রাজনৈতিক কর্মীদের গুম বেড়ে যাওয়ায় বিরোধী রাজনৈতিক দল উচ্চকিত আওয়াজ তুলে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিল। তারা পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রকৃত অবস্থার নির্মমতা তুলে ধরছিল। পত্র-পত্রিকাও এসব সংবাদ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করে আসছিল। বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল না, রাজনৈতিক দলগুলোর পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এই তৎপরতাকে কয়েকজন মন্ত্রী তীর্যক ভাষায় নিন্দা করেন। তাদের বক্তব্য ছিল- বিরোধী রাজনৈতিক দলটি রাজপথের আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বিদেশি প্রভুদের দ্বারস্থ হয়েছে। একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্যে এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে- এ ধরনের মন্তব্য তারা ঘরে-বাইরে করেই যাচ্ছিলেন। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে মার্কিন সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্য পর্যায়ের ঐ কর্মকর্তার বাংলাদেশ সফর ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এই বৈঠকটি ছিল সাংবাদিকদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর রেওয়াজ অনুযায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী উপস্থিত সাংবাদিকদের বৈঠকের বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবহিত করেন। কখনো কখনো সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটি কোন আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন নয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত বিষয়াদি ও খুঁটিনাটি নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে যেসব সাংবাদিক তথ্য সংগ্রহ ও পরিবেশন করেন তারাই নিজেদের গরজে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক নজরে রাখেন এবং বৈঠক স্থানে কখনো কখনো অনাহূতের মতো হাজির হয়ে থাকেন। তবে মার্কিন কর্মকর্তার সঙ্গে ঐ বৈঠকটি দেশের তৎকালীন প্রেক্ষাপটে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমিও সেখানে রয়টার্সের প্রতিনিধি হিসেবে সংবাদ সংগ্রহের জন্য উপস্থিত হই। প্রায় ঘণ্টাকাল রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে মার্কিন কর্মকর্তা তার সঙ্গীদের নিয়ে বেরিয়ে আসেন। সাংবাদিকরা বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা ক্যামেরা নিয়ে তাকে ঘিরে ধরেন এবং বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করে নিচে নেমে যান। পরে সাংবাদিকরা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন বৈঠকের বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবহিত করার জন্য। মন্ত্রী যেসব কথা বললেন, তার বেশির ভাগই ছিল গৎবাঁধা। আমি প্রশ্ন করলাম, ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার সম্পর্কে মার্কিন কর্মকর্তা কী বলেছেন? কারণ তাদের প্রতিবেদনে এক রকম কড়া ভাষায় নিন্দা করা হয়েছে।’ জবাবে তিনি বললেন, ‘আমরা তাকে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছি। তারা অনুধাবন করতে পেরেছেন, এটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের অপপ্রচার মাত্র। সরকারকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্যে বিরোধী রাজনৈতিক দল এইঅপপ্রচার বিরতিহীনভাবে ঘরে- বাইরে চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের আমরা নিরপেক্ষ কোনো সূত্র থেকে এসব অভিযোগ যাচাই করার অনুরোধ জানিয়েছি। তারা আমাদের ওপর আস্থা রেখেছেন এবং আমাদের সহনশীল রাজনৈতিক চর্চা ও অনুশীলনের প্রশংসা করেছেন। তারা স্বীকার করেছেন, পৃথিবীর বহু দেশের তুলনায় আমাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি অনেক ভালো। আমরা রাজনৈতিক দলের জন্য যথেষ্ট ছাড় দিচ্ছি যাতে তারা কোনো চাপ ছাড়াই তাদের রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করতে পারেন। মার্কিন প্রতিনিধিদল তারও প্রশংসা করেছেন। তারা বলেছেন, ওয়াশিংটনে ফিরে গিয়ে তারা বৈঠকের বিষয় তুলে ধরে প্রতিবেদন পেশ করবেন।’
আমি অফিসে ফিরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য সামনে এনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, বিরোধী রাজনৈতিক দলের অবস্থান, অভিযোগ- নেপথ্যের এসব বিষয় তুলে ধরে একটি রিপোর্ট করি। সিঙ্গাপুরে ডেস্কের সংশ্লিষ্ট সম্পাদক বারবার মার্কিন কর্মকর্তার বক্তব্য কি জানতে চাচ্ছিলেন। আমি তাকে জানালাম যে, বৈঠক শেষে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সম্পাদক আমাকে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ করে এ প্রসঙ্গে তাদের বক্তব্য জানার জন্য চাপ দিতে থাকেন। আমি বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। এর পর দীর্ঘক্ষণ ডেস্ক থেকে আর কোনো সাড়া পেলাম না এবং ধরে নিলাম এই রিপোর্ট খারিজ করে দেয়া হয়েছে। পরের দিন ডেস্কের সংশ্লিষ্ট সম্পাদক আমার রিপোর্টটি সম্পাদনা শেষে আমার কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেন ভালোভাবে দেখার জন্যে। সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মন্তব্য সংবলিত সূচনা বক্তব্য। স্পষ্টতই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যকে অস্বীকার করা হয়েছে। ওয়াশিংটনে রয়টার্সের যে সাংবাদিক পররাষ্ট্র দপ্তরের সংবাদ সংগ্রহ করেন তাকে এই রিপোর্টে যুক্ত করে বক্তব্য নেয়া হয়েছে। রয়টার্সের বিশ্বব্যাপী কার্যক্রম চলমান আছে বলেই এ ধরনের সংবেদনশীল রিপোর্টে উভয়পক্ষের বক্তব্য যুক্ত করা সম্ভব। সংশ্লিষ্ট সম্পাদক বললেন, ‘বৈঠকে উপস্থিত উভয়পক্ষের বক্তব্য ছাড়া এ ধরনের রিপোর্ট পাঠকদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না। তাই আমাদের রিপোর্টকে বিশ্বাসযোগ্য করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।’

লেখক: রয়টার্সের সাবেক ব্যুরো প্রধান এবং বর্তমানে অ্যামচ্যাম জার্নালের সম্পাদক।

সূত্র: মানবজমিন।

error: