প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আমরা বড় যুদ্ধাবস্থার ভেতরে আছি। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের পর দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য যত রকম পারে, চেষ্টা চলছে। এখান থেকে আমাদের দেশকে রক্ষা করতে হবে। তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। আগামী বছরের ৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেছেন, জুলাইয়ের ১ তারিখেও যাবে না।
গতকাল রোববার তাঁর সরকারি বাসভবন যমুনায় রাজনৈতিক দলগুলোর ১৯ নেতার সঙ্গে দ্বিতীয় দিনের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা এসব কথা বলেছেন বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। রাজনৈতিক দলের নেতারা জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টা বিদ্যমান সংকট কাটিয়ে উঠতে তাদের সহযোগিতাও চেয়েছেন।
বৈঠকে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বিভাজন থেকে আমাদের উদ্ধার পেতে হবে। ঐকমত্য থাকতে হবে। আত্মমর্যাদাপূর্ণ জাতি হিসেবে আমরা যতটুকু দাঁড়াতে পেরেছি, এটি যেন সামনের দিকে যায়। অভ্যুত্থানের কারণে মহাসুযোগ পেয়েছি ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেশকে টেনে আনার। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে দেশের ভেতর এবং বাইরে আমরা যাতে এগোতে না পারি। যাতে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়। আবার যাতে গোলামিতে ফেরত যাই।
তিনি বলেন, সবাই একসঙ্গে বসায় সাহস পেলাম। সুষ্ঠু নির্বাচন করতে না পারলে আমি অপরাধী অনুভব করব।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমি যতদিন আছি, দেশের কোনো অনিষ্ট হবে, এমন কোনো কাজ আমাকে দিয়ে হবে না। নিশ্চিত থাকেন।
বৈঠক শেষে রাতে প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রেস সচিব আরও বলেন, রাজনৈতিক নেতারা অধ্যাপক ইউনূসকে সমর্থন জানিয়েছেন। আমরা যে সংস্কার করছি, আমরা যে বিচারকাজ শুরু করেছি, নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু করেছি, সেটাতে তারা সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, অনেকগুলো বিষয়ে কথা হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে ও সংস্কার বিষয়ে কথা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা আবারও জানিয়েছেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন করবেন। ৩০ জুনের ওই পারে যাবে না। এতে সবাই সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
দ্বিতীয় দিনের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিন উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন। তারা হলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ ও শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান।
গতকাল বিকেল ৫টায় প্রথম দফার বৈঠকে যোগ দেন এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম, সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান মঞ্জু, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, জাতীয় গণফ্রন্টের সমন্বয়ক টিপু বিশ্বাস, ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম এবং জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন।
পরে সন্ধ্যা ছয়টায় দ্বিতীয় দফায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমেদ আবদুল কাদের, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা সাদিকুর রহমান প্রমুখ। বৈঠক শেষে দলগুলোর নেতারা যমুনার সামনে বৈঠকের আলোচনার বিষয়বস্তু তুলে ধরেন।
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ নানা সংকটে রাজনৈতিক নেতাদের কাছে তাঁর উদ্বেগের কথা জানান। এই অবস্থায় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার বিষয়ে সংশয়ের কথাও জানান তিনি। জবাবে রাজনৈতিক দলগুলো তাঁকে পেশাদারিত্ব বজায় রেখে কাজ করার আহ্বান জানান। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা ও তাদের পরামর্শ গ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তারা।
বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, জুলাই আন্দোলনের স্পিরিট নস্যাৎ করার প্রক্রিয়া চলছে। জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে যদি আমরা সংস্কার কাজে এগিয়ে নিয়ে যাই, তাহলে সেটাই হবে আসল সংস্কার। তাই আমরা জনগণের অংশগ্রহণ ও মতামত নিয়ে সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের কথা বলেছি। অবাধ নির্বাচনের জন্য যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন, সেটুকু করে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেছি। এটাও বলেছি, এ ক্ষেত্রে যত বেশি বিলম্ব করা হবে, ততই সংকট বাড়বে। দেশ রক্ষায় ব্যর্থ হলে জুলাই গণআন্দোলনের রক্তের সঙ্গে বেইমানি হবে।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান মঞ্জু বলেন, সংস্কার এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হওয়া হত্যাকাণ্ডের বিচার করে আগামী বছরের ৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচন দেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি।
তিনি বলেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি আসলে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন কিনা? তাঁর কথায় যেটি বুঝেছি, তাঁর কাছে মনে হয়েছে, একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়ার মতো যে সহযোগিতা ও পরিবেশ, সেটা পাচ্ছেন না বলেই উপদেষ্টাদের বৈঠকে বলেছিলেন, তিনি আর থাকবেন না। তিনি জাতির উদ্দেশে একটা বক্তব্য দিয়ে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার কথা বলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত উপদেষ্টারা বুঝিয়ে তাঁকে তা থেকে নিবৃত করেছেন।
মঞ্জু বলেন, আমরাও তাঁকে বলেছি, তিনি পদত্যাগ করলে নির্বাচন, সংস্কারসহ সবকিছু আরও অনিশ্চিত হয়ে যাবে। প্রধান উপদেষ্টা আমাদের যা বলেছেন তাঁর মূল টার্গেট হচ্ছে, একটা সুষ্ঠু ও ঐতিহাসিক নির্বাচন দেওয়া। কিন্তু সেই নির্বাচন দেওয়ার জন্য প্রশাসনসহ সব বিষয়ে তাঁর একটা নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব স্থাপন করার দরকার।
তিনি বলেন, আমরা বলেছি, রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে ড. ইউনূসের টানাপোড়েন চলছে। সমঝোতা বা যেভাবেই হোক, এটিকে একটা স্বস্তির জায়গায় নিতে হবে। তা ছাড়া ছাত্রদের সঙ্গেও দূরত্ব দূর করার কথা বলেছি।
চলমান সংকট নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা চিন্তিত জানিয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, অনেক বড় সংকটের মধ্যে আমরা আছি। এই সংকটের জন্য প্রধানত ভারতীয় আধিপত্যবাদের ষড়যন্ত্রের কথা তিনি বলেছেন। ভারতীয় আধিপত্যবাদ আমাদের এই পরিবর্তনকে একেবারে স্বীকার করতে চায় না। পারলে আমাদের একদিনে ধ্বংস করে দিতে চায়। সে জন্য যা যা করার দরকার, সব তারা করছে– এই ছিল তাঁর (প্রধান উপদেষ্টা) কথা।’
মান্না আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টা চাইছেন, সব জাতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার। কিন্তু দিন দিন এই ঐক্য দুর্বল হচ্ছে। এ জন্যও তিনি চিন্তিত এবং বেশ খানিকটা হতাশ।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি করেছি। আমরা প্রস্তাব দিয়েছি, সবাইকে যেন সমানভাবে মূল্যায়ন করা হয়। কারণ, সরকারের নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে। উপদেষ্টারা একেক সময় একেক কথা বলছেন। করিডোর ও বন্দরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত না নিতে বলা হয়েছে। ছাত্র উপদেষ্টাদের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, বিতর্কিতদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত কী নেবেন, তা তাঁর ওপর নির্ভর করছে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, সরকার এরই মধ্যে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছে। আজকের বৈঠকে আমরা বলেছি, একটা নির্দিষ্ট মাস ও সপ্তাহ কিংবা সুনির্দিষ্ট তারিখ বলা যেতে পারে।
তিনি বলেন, জনগণ জুলাই গণহত্যার দৃশ্যমান বিচার দেখতে চায়। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, এই বিচারকাজে সরকারের দিক থেকে বিচার বিভাগকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু বলেন, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও প্রশাসনকে আস্থায় আনতে হবে। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এটি অত্যন্ত প্রয়োজন।
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা আসলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে চেয়েছেন। আমরা বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনকে পরস্পরের বিপরীতে দাঁড় না করিয়ে একটা সমন্বিত রোডম্যাপ প্রণয়ন করার জন্য বলেছি।
হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান বলেন, বিগত সরকারের আমলে হেফাজতের বিরুদ্ধে করা ২০০-এর বেশি মিথ্যা মামলা আগামী জুনের মধ্যে প্রত্যাহার করতে হবে– এ দাবি জানানো হয়েছে। নারী সংস্কার কমিশনের অনেক সুপারিশ কোরআন-হাদিসের পরিপন্থি। এ জন্য এমন কোনো সুপারিশ বাস্তবায়নযোগ্য নয়। প্রয়োজনে পরিষদ পুনর্গঠনের কথাও বলা হয়েছে।
খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক বলেন, পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস যেন মাঝপথে হাল ছেড়ে না দেন– এ বিষয়ে আমরা তাঁকে অনুরোধ করেছি। তিনি নিজেও আমাদের আশ্বস্ত করেছেন।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমেদ আবদুল কাদের বলেন, যেসব উপদেষ্টাকে নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, সে ব্যাপারে বিবেচনা এবং একই সঙ্গে জুলাই আন্দোলনের বিচার দৃশ্যমান করার কথা বলেছি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি রেজাউল করিম (চরমোনাই পীর) বলেন, সরকারকে চারটি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে– সংস্কার করে নির্বাচন করা, স্পর্শকাতর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ করা, স্থানীয় নির্বাচন আগে করা এবং ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে আমাদের সমর্থন আছে।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, দুই উপদেষ্টাকে পদত্যাগের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারকে বলেছি। আমাদের আন্দোলনকারী ছাত্র নেতৃত্বের মধ্যে যারা উপদেষ্টা রয়েছেন, তারা যেহেতু একটি দল করেছেন, বাইরে এ কথাটি প্রচলিত– এই দলটি সরকারের সুবিধা পাচ্ছে এবং সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করছে। দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এনসিপির দু’জনকে অপসারণ করা বা তাদের বুঝিয়ে পদত্যাগের দিকে যাওয়া সরকারের দিক থেকে একটি ভালো দিক হবে।
এর আগে শনিবার বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা।
সূত্র: সমকাল।