জন ড্যানিলোভিজ
লেনিন একবার বলেছিলেন- ‘কখনো কয়েক দশক ধরে কিছুই ঘটে না। আবার কখনো কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কয়েক দশকের ঘটনা ঘটে যায়।’ দীর্ঘদিনের বাংলাদেশ পর্যবেক্ষক হিসেবে, ঢাকার ঘটনাগুলো বিবেচনা করার সময় আমি রাশিয়ান বিপ্লবীর সঙ্গে একমত হতে পারছি না। বাংলাদেশের মাটিতে সমস্ত উন্নয়নের খোঁজ রাখা কঠিন, বিশেষ করে যখন কেউ হাজার হাজার মাইল দূরে বসে থাকে। একই সঙ্গে এই দূরত্ব কিছু দৃষ্টিকোণ প্রদান করতে পারে। আমি যখন এই কলাম লিখতে বসেছি, আমার মনের মধ্যে তখন ঘুরপাক খাচ্ছে চিন্ময় কৃষ্ণ দাশকে গ্রেপ্তার এবং পরবর্তী সহিংসতা। যার জেরে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। ব্যাপক অনলাইন বিভ্রান্তি এবং পক্ষপাতমূলক প্রতিবেদনের মাধ্যমে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। নয়াদিল্লি এবং ঢাকা উভয়ের সরকারই রক্ষণাত্মক অবস্থান নিয়েছে, প্রাথমিকভাবে নিজের দেশকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে বিবৃতি জারি করেছে। যদিও এখনো পর্যন্ত সীমান্তের উভয়দিকের জনগণের ক্ষোভ প্রশমিত করতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে খুব কমই উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়েছে।
অনলাইন হিন্দুত্ববাদী ট্রোলারদের আর বেশি করে বিভ্রান্তি ছড়ানোর আগে আমি ভারত সরকার এবং জনসাধারণকে কিছু পরামর্শ দিতে চাইবো। সহজ কথায়, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের সাফল্য এবং তিনি যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তার দ্বারা ভারতের সর্বোত্তম স্বার্থ পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইউনূসের নেতৃত্ব এমন একটি জনপ্রিয় সরকারের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পথ প্রশস্ত করবে যা অতীতের শাসনব্যবস্থার অপকর্মকে বাধা দেবে। একটি শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ যা তার নাগরিকদের অধিকারকে সম্মান জানানোর পাশাপাশি ভারত এবং তার ইন্দো-প্যাসিফিক অংশীদারদের জন্য কার্যকরী প্রতিপন্ন হবে।
আমি যখন ভারত সরকার, অন্যান্য ভারতীয় নেতা এবং প্রক্সিদের দ্বারা গৃহীত পদক্ষেপগুলো দেখি, তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য প্রচারের পরিবর্তে ভারতীয় নীতিগুলো দুর্বল ও অস্থিতিশীল বলে প্রতীয়মান হয়।কর্তৃত্ববাদী হাসিনার প্রতি সমর্থন তুলে নিয়ে জেনারেল জেডের সাথে সেতু নির্মাণের পরিবর্তে, ভারতের কৌশলগুলো আরও বেশি ভারত-বিরোধী মনোভাবের জন্ম দিচ্ছে। একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে সাহায্য করার পরিবর্তে ভারতীয় নীতি হলো- হিন্দু সংখ্যালঘুদের দাবার ঘুঁটির মতো ব্যবহার করে আন্তঃসামপ্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ানো। হতে পারে যে, এই কৌশল মোদি সরকারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণ করে, তবে এটি বাংলাদেশে ভারতের অবস্থানকে উন্নত করার পরিবর্তে আরও কঠিন করে তোলে।
ভারতীয় নীতি ‘সফল হলে’ তার ফলাফল কী হতে পারে এবার সেটা বিবেচনা করা যাক। অন্তর্বর্তী সরকার যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে কিছু কার্যকরী বিকল্প আছে। যেমন ভারতের পছন্দের প্রার্থী (শেখ হাসিনা বা তার পরিবারের সদস্য) জুলাই এবং আগস্টে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করার পরও বাংলাদেশ শাসন করতে ফিরে আসতে পারেন। অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকার সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তবে এটি ভারতের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব মেটানোর ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশ শাসনে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। তারা জানে যে, ক্ষমতা কাঁধে নিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বিপন্ন হতে পারে। কিংবা সেনাবাহিনী বাংলাদেশের জনগণের কাছ থেকে জনসমর্থন পাবে না। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতার সবচেয়ে সম্ভাব্য পরিণতি হবে কোনো সংস্কার ছাড়াই নির্বাচন। বর্তমান পরিবেশে, এটি সম্ভবত একটি কট্টর ভারত-বিরোধী সরকারের জন্ম দেবে। তা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা অন্য কোনো জোট দ্বারা গঠিত হোক না কেন।
সুতরাং, আরও একবার মনে করিয়ে দিতে চাই, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্যেই ভারতের স্বার্থ নিহিত। বর্তমানে আন্তর্জাতিক নেতাদের একটি বিস্তৃত জোট রয়েছে যারা প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস এবং তার দলকে সফল করতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে ভারত বাংলাদেশের সমস্যার সমাধানের অংশ হতে পারে। এই প্রক্রিয়াটি শুরু করার জন্য, প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসকে সরাসরি কথা বলতে হবে- ব্যক্তিগতভাবে।
অতীতে, প্রধানমন্ত্রী হাসিনা যখন ফোন করতেন তখন মোদি তার সময় নিয়ে বদান্যতা দেখিয়েছেন। ইউনূসের সঙ্গেও কথা বলার সময় সেই দৃষ্টিভঙ্গি রাখা উচিত। এই আলোচনার শীর্ষে যে বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে তা হলো- সীমান্তে ভারতীয় দিক থেকে আসা বিভ্রান্তি ছড়ানোর প্রচেষ্টাকে দমন করার প্রতিশ্রুতি। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদী কণ্ঠের নেতৃত্বে যে আন্তর্জাতিক প্রচারণা চলছে তা বন্ধ করা দরকার, হিন্দু সংখ্যালঘুদের স্বার্থেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। এর অংশ হিসেবে, নতুন দিল্লির সঙ্গে উত্তেজনা কমাতে অন্তর্বর্তী সরকার আরও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। প্রশংসনীয়ভাবে, প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস এবং তার দল তাদের কর্মের মূল্যায়নের জন্য আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ তদন্তকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা স্বীকার করেছে যে, তারা নিখুঁত নয় এবং তাদের ভুল সংশোধন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। সংখ্যালঘুদের মর্যাদা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের একটি সহজ প্রতিক্রিয়া হলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠী, সাংবাদিক এবং সরকারগুলোর জন্য দরজা খুলে দেয়া। আমরা জানি সূর্যের আলো সবচেয়ে ভালো জীবাণুনাশক। তাই যে যে সমস্যা আছে, সেগুলো সমাধান করা দরকার।
অনুমান করা হচ্ছে যে, হানিমুন পিরিয়ড শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে সংকট উপস্থিত। যারা একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়তে চান তাদের এখনই একত্রিত হওয়া দরকার যাতে এই স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয়। বাংলাদেশকে সফল করতে ভারতেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এখনই সময়, নয়াদিল্লির কৌশল পুনর্মূল্যায়ন করার।
লেখক: জন ড্যানিলোভিজ একজন স্বাধীন বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষক এবং অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র ফরেন সার্ভিস অফিসার।
সূত্র: ঢাকা ট্রিবিউন