এমসি কলেজ গৃহবধু ধর্ষন মামলা: কার্যত অচল

সিলেট এমসি কলেজে স্বামীকে আটকে রেখে গৃহবধূকে গণধর্ষণ মামলা কার্যক্রম কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। গেল বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয় চাঞ্চল্যকর ও লোমহর্ষক মামলার জেলা মনিটরিং কমিটি। কিন্তু, দীর্ঘ এক বছর অতিবাহিত হলেও এর কোনো অগ্রগতি নেই।
করোনাকালীন লকডাউনের পর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলার ধার্য তারিখ থাকলেও কোনো আসামিকে আদালতে আনা হচ্ছে না। ফলে মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে বাদীপক্ষের মধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

বাদীপক্ষের আইনজীবী প্যানেলের প্রধান এডভোকেট শহীদুজ্জামান চৌধুরী সিলেটের ডাককে জানিয়েছেন, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ করতে জেলা চাঞ্চল্যকর ও লোমহর্ষক মামলার মনিটরিং কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। অথচ, এক বছর পেরিয়ে গেলেও এর কোনো অগ্রগতি নেই। মামলাকে ‘গলাটিপে শ্বাসরোধ’ করা হচ্ছে। অতীতে কোনো মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে যেতে এতো দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার কোনো নজির নেই। সর্বশেষ কোন পর্যায়ে রয়েছে তাও জানা সম্ভব হচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। এখন আসামীদেরকেও আর আদালতে আনা হয় না। গতকালও মামলার ধার্য তারিখ ছিল। কিন্তু কোনো আসামিকে আনা হয়নি।

সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পিপি এডভোকেট রাশিদা সাঈদা খানম জানান, গত বছর গণধর্ষণের মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এখনো চাঁদাবাজি ও অস্ত্র আইনের মামলার অভিযোগ গঠন করা বাকি রয়েছে। এই মামলার অভিযোগ গঠন করার পরে মামলা দুটির বিচার কার্যক্রম একসাথে চলবে। তবে, কবে নাগাদ অভিযোগ গঠন করা হতে পারে-এর নির্দিষ্ট কোনো দিন-তারিখ তিনি জানাতে পারেননি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চাঞ্চল্যকর ও লোমহর্ষক মামলার সিলেট জেলা মনিটরিং কমিটির সদস্যসচিব ও গোয়াইনঘাট সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার প্রভাস কুমার সিংহ গতকাল সোমবার রাতে সিলেটের ডাককে জানিয়েছেন, মামলাটি ভুলবশত দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণের কথা লেখা হয়েছিল। ওই সভায় মূলত মামলাটির বিচার কার্যক্রম দ্রুত নিষ্পত্তির জন্যে আলোচনা হয়। যাতে আলামত ঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়, সাক্ষীদেরকে যথাসময়ে আদালতে হাজির করা হয়। প্রয়োজনীয় আইনগত সহযোগিতা প্রদান করতে সভায় অংশগ্রহণকারীরা আলোচনা করেন। পরবর্তী সভায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণের কথা সংশোধন করা হয়েছে। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণের প্রয়োজন নেই। যেহেতু এখানে আলাদাভাবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। এই ট্রাইব্যুনালেই মামলার বিচার কার্যক্রম নিষ্পত্তি হবে। ওই সভার পরে এই কমিটি মামলাটির ব্যাপারে আর কোনো আলোচনা করেনি। তবে, এটি একটি আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর মামলা। যাতে দ্রুততম সময়ে মামলার কার্যক্রম নিষ্পত্তি করে, ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা যায়-এজন্যে সংশ্লিষ্টদের সাথে আমরা আলোচনা করতে পারি।

বাদীপক্ষ সূত্র জানায়, গেল বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি সিলেটের তৎকালীন জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলামের সভাপতিত্বে চাঞ্চল্যকর ও লোমহর্ষক মামলার জেলা মনিটরিং কমিটির সভায় এমসি কলেজের হোস্টেলে গৃহবধূকে গণধর্ষণ মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর ইতোমধ্যে এক বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতি নেই। জেলা মনিটরিং কমিটির সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আদৌ পৌঁছেছে কিনা এ বিষয়েও কারো নিকট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বাদীপক্ষের আইনজীবীগণ বিষয়টির সর্বশেষ তথ্য জানতে অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন বলে সিলেটের ডাককে জানিয়েছেন। গতকাল সোমবার সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মোহিতুল হক চৌধুরীর আদালতে মামলার ধার্য তারিখ ছিল।
কিন্তু, কোনো আসামিকে আদালতে আনা হয়নি। লকডাউনের পর আদালতের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চললেও কোনও ধার্য তারিখে আসামিদেরকে নিয়ে আসা হয়নি। বর্তমানে মামলার কার্যক্রম কার্যত অচল হয়ে পড়েছে বলে বাদীপক্ষের আইনজীবী প্যানেলের প্রধান এডভোকেট শহীদুজ্জামান চৌধুরী জানিয়েছেন।

সূত্র জানায়, গেল বছরের ১৭ জানুয়ারি রোববার সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মোহিতুল হক চৌধুরীর আদালতে সকল আসামির উপস্থিতিতে অপহরণ, গণধর্ষণ ও গণধর্ষণে সহায়তার অভিযোগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অভিযোগ গঠন করা হয়।

অভিযোগ গঠনের পর ২৭ জানুয়ারি মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য্য করেছিলেন আদালত। কিন্তু, বাদীপক্ষ উচ্চ আদালতে একসাথে একই আদালতে মামলা দুটি চালানোর আবেদন করে। আবেদনটি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে যাননি। ওইদিন সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে প্রথম সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ থাকার পরও ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে যাননি মামলার বাদীসহ পাঁচ সাক্ষী। এরপর ৭ ফেব্রুয়ারি পুনরায় সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ধার্য করেন আদালত। ওইদিন গ্রেফতারী পরোয়ানামূলে মামলার বাদীকে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য আদালতে ধরে নিয়ে আসে পুলিশ। ওইদিন উচ্চ আদালত শুনানি শেষে আদেশ দেন। তাৎক্ষণিকভাবে উচ্চ আদালতের আদেশের কপি সরবরাহ করা হলে সাক্ষ্য গ্রহণ না করে বাদীকে ছেড়ে দেয়া হয়।

এদিকে, গেল বছরের ২৪ জানুয়ারি আদালতে দুটি মামলার বিচারকাজ একসঙ্গে শুরু করার আবেদন করেছিলেন বাদীপক্ষ। শুনানি শেষে বিচারক আবেদনটি খারিজ করে দেন। এরপর বাদীপক্ষ মামলা দুটির বিচার কার্যক্রম একই আদালতে সম্পন্নের জন্য চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে উচ্চ আদালতে একটি ফৌজদারি বিবিধ মামলা করেন। ফৌজধারি বিবিধ মামলা নম্বর -৮৯৫২/২০২১। ওই বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের ভার্চ্যুয়াল বেঞ্চ এ মামলার শুনানি করেন। শুনানি শেষে আদালত মামলা দুটির বিচার কার্যক্রম একসাথে একই আদালতে সম্পন্নের আদেশ দেন।

আলোচিত এই গণধর্ষণের ঘটনায় সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার চান্দাইপাড়ার তাহিদ মিয়ার পুত্র সাইফুর রহমান (২৮), হবিগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার বাগুনীপাড়ার শাহ জাহাঙ্গির মিয়ার পুত্র শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনি (২৫), দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার উমেদনগরের মৃত রফিকুল ইসলামের পুত্র তারেকুল ইসলাম তারেক (২৮), জকিগঞ্জের আটগ্রামের মৃত অমলেন্দু লস্কর ওরফে কানু লস্করের পুত্র অর্জুন লস্কর (২৬), দিরাই উপজেলার বড়নগদীপুরের দেলোয়ার হোসেনের পুত্র রবিউল ইসলাম (২৫), কানাইঘাট উপজেলার লামা দলইকান্দির (গাছবাড়ী) সালিক আহমদের পুত্র মাহফুজুর রহমান মাসুম (২৫), সিলেট নগরীর গোলাপবাগ আবাসিক এলাকার (বাসা নং-৭৬) মৃত সোনা মিয়ার পুত্র আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল (২৬) ও বিয়ানীবাজার উপজেলার নটেশ্বর গ্রামের মৃত ফয়জুল ইসলামের পুত্র মিজবাউল ইসলাম রাজনকে (২৭) অভিযুক্ত করে দন্ডবিধির ৩৪২/৩২৩/৩৭৯/৩৮৫/৩৪ ধারা তৎসহ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী, ২০০৩)এর /৭/৯/(৩) ৩০ ধারায় অভিযোগপত্র গত ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর আদালতে জমা দেয় পুলিশ। এতে ৫২ জনকে সাক্ষী রাখা হয়। ঘটনার ২ মাস ৮ দিন পর ১৭ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রটি আদালতে জমা দেয়া হয়।

গ্রেফতারকৃত এই ৮ আসামির সকলেই অকপটে আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। ৮ আসামির মধ্যে, সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেকুল ইসলাম তারেক ও অর্জুন লস্কর, মিজবাহুল ইসলাম রাজন ও আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল ১৯ বছর বয়সী ওই নববধূকে সরাসরি গণধর্ষণ করে। রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান মাসুম ধর্ষণে সহযোগিতা করে। ৮ আসামীর সকলেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল। তারা ছাত্রলীগের টিলাগড় গ্রুপে সক্রিয় ছিল। বর্তমানে ৮ আসামি সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রয়েছে।

এদিকে, গণধর্ষণের ঘটনার আগে অস্ত্র মামলার অভিযোগপত্র আগে জমা দেয় পুলিশ। ঘটনার ১ মাস ২৭ দিন পর ২২ নভেম্বর অভিযোগপত্রটি জমা দেয়া হয়। ছাত্রাবাস থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতা সাইফুর রহমান ও শাহ মাহবুবুর রহমান রনিকে আসামি করে ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইনের ১৯/১৯এ ধারায় অভিযোগপত্রটি জমা দেয়া হয়।

ভয়ঙ্কর সেই সন্ধ্যা
গেল ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর শুক্রবার বিকেলে দক্ষিণ সুরমার জৈনপুরের ২৪ বছর বয়সী এক যুবক তার ১৯ বছর বয়সী নববিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে প্রাইভেটকারযোগে এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে ঘুরতে যান। এর আগে শাহপরান (রহ.) মাজারও ঘুরে আসেন তারা। সন্ধ্যার পরে এমসি কলেজের প্রধান ফটকের সামনে তারা থামেন। এ সময় কয়েক জন যুবক ওই স্বামী ও তার স্ত্রীকে ঘিরে ধরে। এক পর্যায়ে প্রাইভেটকারসহ তাদেরকে জোরপূর্বক জিম্মি করে কলেজের ছাত্রাবাসের অভ্যন্তরে নিয়ে যায়। এরপর স্বামীকে আটকে রেখে ছাত্রাবাসের ৭নং ব্লকের ৫ম তলা বিল্ডিংয়ের সামনে প্রাইভেটকারের মধ্যেই গৃহবধূকে ধর্ষণ করে। তারা দম্পতির সাথে থাকা টাকা, স্বর্ণের চেইন ও কানের দুল ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আটকে রাখে তাদের প্রাইভেট কারও। ছাত্রাবাস থেকে টিলাগড় পয়েন্টে এসে যুবকটি পুলিশে ফোন দেন। পুলিশ আসতে বেশ সময়ক্ষেপণ করার সুযোগ পেয়ে ধর্ষকরা পালিয়ে যায়। পরে পুলিশ নির্যাতিতাকে ওসমানী হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি করে। ঐ রাতেই নির্যাতিতার স্বামী মাইদুল ইসলাম বাদী হয়ে ৬ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরো ৩-৪ জনকে আসামী করে শাহপরান (রহ:) থানায় মামলা করেন। শাহপরান (রহ:) থানার মামলা নং- ২১। তারিখ-২৬/০৯/২০২১।
দেশের অন্যতম পুরনো বিদ্যাপীঠ এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গৃহবধূকে গণধর্ষণের ঘটনায় দেশব্যাপী তুমূল আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রেক্ষিতে সরকার ধর্ষণের সাজার আইনের পরিবর্তন করে মৃত্যুদন্ডের ঘোষণা দেয়। ২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান করে জাতীয় সংসদে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) বিল ২০২০ পাশ হয়।
গৃহবধূ ধর্ষণের ঘটনায় কলেজের অধ্যক্ষ সালেহ আহমেদ ও হোস্টেল সুপার জীবন কৃষ্ণ আচার্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এদিকে, ধর্ষণের ঘটনায় কলেজ কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় কোনো ঘাটতি ছিল কিনা, তা খতিয়ে দেখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল।

ছাত্রত্ব-সার্টিফিকেট বাতিল
গণধর্ষণের ঘটনায় দেশব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে। সিলেটসহ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে ধর্ষণবিরোধী তীব্র আন্দোলন। ঘটনার পর এমসি কলেজের ছাত্র সাইফুর রহমান, মাহবুবুর রহমান রনি, মাহফুজুর রহমান মাসুম ও রবিউল হাসানকে কলেজ কর্তৃপক্ষ স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে। এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও এই ৪ জনের ছাত্রত্ব ও সার্টিফিকেট বাতিল করে।

সূত্র: সিলেটের ডাক

error: