করোনাকালে দেশের আলোচিত অপরাধগুলো

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গত মার্চ থেকেই দেশে বেশকিছু বিধিনিষেধ জারি ছিল যা বিঘ্নিত করেছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। কিন্তু মহামারীর মধ্যেও নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র ছিল বিদায়ী বছরের অন্যতম উদ্বেগের বিষয়। বছরজুড়ে ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যাসহ যৌন হয়রানি, পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটেছে।

এসব ঘটনার মধ্যে সিলেট এমসি কলেজে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণ এবং নোয়াখালীতে এক গৃহবধূকে নির্যাতন ও যৌন হয়রানির করার পর সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া ছিল অন্যতম।

এছাড়া গত জুলাইয়ে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভে পুলিশের গুলিতে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানের মৃত্যুও ছিল বিদায়ী বছরের অন্যতম আলোচিত-সমালোচিত ঘটনা।

গত ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের মারিশবুনিয়া পাহাড়ে ভিডিওচিত্র ধারণ শেষে মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকার নীলিমা রিসোর্টে ফেরার পথে টেকনাফের শামলাপুর তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর সিনহা। ঠাণ্ডা মাথায় তাকে হত্যা করা হলেও প্রথমে এ ঘটনাকে বন্দুকযুদ্ধ হিসেবে দাবি করে পুলিশ।

কিন্তু গত ৫ আগস্ট নিহত সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে প্রধান আসামি করে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ পুলিশ সদস্যকে আসামি করে মামলা দায়ের করলে সামনে আসে আসল ঘটনা।

মেজর সিনহা হত্যার পাশাপাশি ধর্ষণ, দলগত ধর্ষণের মতো নারী সহিংসতার বিভিন্ন ঘটনার কারণে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকেও।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে স্বামীকে বেঁধে রেখে ১৯ বছর বয়সী এক তরুণীকে ধর্ষণ করে একদল যুবক। এ ঘটনায় ধর্ষণের শিকার তরুণীর স্বামী বাদী হয়ে সিলেটের শাহ পরান থানায় ছয়জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত তিনজনকে আসামি করে একটি দায়ের করেন।

আলোচিত ওই ঘটনার পর সিলেটে ‘সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণের’ প্রতিবাদে কলেজের সামনে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন এমসি কলেজের শিক্ষার্থীরা।

দেশজুড়ে বিক্ষোভের জন্ম দেয়া জঘন্য ওই ঘটনা সরকারকে এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে। পরে এ ঘটনার সাথে জড়িত আটজনকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তারা বর্তমানে পুলিশি হেফাজতে রয়েছে। এমনকি এই ঘটনা তদন্তে গত ৩০ সেপ্টেম্বর একটি কমিটি গঠন করে হাইকোর্ট।

অক্টোবরের শুরুতে ফেসবুকে ভাইরাল হয় নোয়াখালীর এক গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনা। ঘৃণ্য এ ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ।

তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী, পুলিশ ও র‌্যাবসহ আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা গ্রেপ্তারের মাধ্যমে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন।

সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদেরও কোনোভাবে ছাড় দেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মামলার চার্জশিট (অভিযোগপত্র) গত ৩ ডিসেম্বর আদালতে দাখিল করেছে পুলিশ। চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনার দুই মাসের বেশি সময় পর সিলেটের মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আবুল কাশেমের আদালতে আটজনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ মামলায় গ্রেপ্তার আট আসামির মধ্যে অভিযোগপত্রে সাইফুর রহমানকে প্রধান করে ছয়জনের বিরুদ্ধে সরাসরি ধর্ষণে জড়িত ও দুজনের বিরুদ্ধে সহায়তার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।

চার্জশিটে সরাসরি ধর্ষণে জড়িত বাকি পাঁচজন হলেন- শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনি, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর, মো. আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল ও মিজবাউল ইসলাম রাজন। এছাড়া ধর্ষণে সহায়তা করায় মো. রবিউল হাসান ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান মাসুমকে আসামি করা হয়েছে।

গত ২ সেপ্টেম্বর নোয়াখারীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় উদ্বেগ দেখা দেয় স্থানীয়দের মাঝে। দুর্বৃত্তরা ওই গৃহবধূর পোশাক খুলে নির্যাতন করে ফোনে ধারণ করে এবং এ ঘটনার ৩২ দিন পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিওটি ভাইরাল হলে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় সম্প্রতি প্রধান আসামি দেলোয়ার হোসেন ওরফে দেলুসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। অভিযুক্ত ১৪ জনের মধ্যে এখনও পলাতক রয়েছে চারজন।

গত ৬ অক্টোবর এক বিবৃতিতে, নোয়াখালীতে ভুক্তভোগী ওই নারীর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

দেশে নারীদের প্রতি সহিংসতার ক্রমবর্ধমান ঢেউয়ের সর্বশেষ ঘটনা এটি।

অ্যামনেস্টির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, ‘নোয়াখালীতে গৃহবধূকে নির্যাতন ও যৌন হয়রানির বিরক্তিকর ওই ভিডিও মর্মান্তিক সহিংসতার বিষয়টি তুলে ধরেছে, বাংলাদেশের নারীরা নিয়মিত যার শিকার হন ‘

সরকারের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে মাত্র ৩.৫৬ শতাংশ মামলা দায়ের করা হয়েছে।

বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারী থেকে নভেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে কমপক্ষে ১৫৪৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ৩০৩টি ছিল গণধর্ষণ। তবে ২০১৯ সালের একই সময়ের মধ্যে ৩২৭টি গণধর্ষণের ঘটনাসহ মোট ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ১৪১৩টি।

এদিকে, মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর দেশব্যাপী সমালোচনার মুখে গত ২ আগস্ট উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যেখানে পুলিশের বিরুদ্ধে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যার’ অভিযোগও পুনরায় উত্থাপিত হয়।

গত ৬ আগস্ট বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলী এবং টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপসহ পুলিশের ৭ জন সদস্য সিনহার বোনের দায়ের করা মামলায় আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে তাদের চাকরি থেকেও বরখাস্ত করা হয়।

পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা নিহতের পর বড় রববদল দেখা যায় কক্সবাজার জেলায় পুলিশ বাহিনীতেও।

এছাড়া কক্সবাজারে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং আইজিপি বেনজীর আহমেদ।

গত ১৩ ডিসেম্বর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) আদালতে দাখিল করা হয়েছে।

কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালতে এই চার্জশিট দাখিল করেন কক্সবাজার র‍্যাব-১৫ এর কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা খায়রুল ইসলাম।

তিনি জানান, সিনহা হত্যা মামলায় ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ জন জেল-হাজতে এবং একজন পলাতক রয়েছেন।

এদিকে করোনাকালেও ঘটেছে ‘বিচার বহির্ভূত’ হত্যার অনেক ঘটনা।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্টের মধ্যে আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থার কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন ১৮৪ জন।

তবে এসব ঘটনা নিয়ে তীব্র উদ্বেগ প্রকাশের পর আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দ্বারা এ ধরনের কোনো ‘বন্দুকযুদ্ধের’ খবর পাওয়া যায়নি।

সূত্র ঃ নয়া দিগন্ত

error: