পবিত্র রমজানে অন্য সময়ের চেয়ে ব্যস্ত থাকে রান্নাঘর। সেহ্রি-ইফতারকে কেন্দ্র করে ঘরে থাকে বাড়তি আয়োজন। অথচ এবার প্রথম রোজা থেকেই এই আয়োজনে বাগড়া দিচ্ছে গ্যাসের তীব্র সংকট। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাজুড়ে গ্যাসের চাপ কম থাকায় রান্না করতে পারছেন না নগরবাসী। এতে সেহ্রি ও ইফতার করতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তাদের। এদিকে বাসা-বাড়ির সঙ্গে রাজধানীর বিভিন্ন সিএনজি স্টেশনেও গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে গ্যাসচালিত যানবাহন চালকরাও পড়েছেন বিড়ম্বনায়। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়েও তারা নিতে পারছেন না পর্যাপ্ত গ্যাস।
রাজধানীর বাসাবো, বৌদ্ধমন্দির, খিলগাঁও, চৌধুরীপাড়া, রামপুরা, মুগদা, ইস্কাটন, বাংলামোটর, আগারগাঁও, মিরপুর, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের প্রকট সংকট ধারণ করেছে।
ফলে রমজানের মধ্যে এসব এলাকার বাসিন্দারা তীব্র ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন। রোববার সকাল থেকেই গ্যাসের সংকট শুরু। গতকাল পরিস্থিতি ছিল একই। বিভিন্ন এলাকার গ্রাহকরা জানিয়েছেন, রোববার সকাল ৮টার পর থেকেই চুলায় গ্যাসের উপস্থিতি নেই। সন্ধ্যার দিকে কিছু বাড়িতে সামান্য গ্যাস থাকলেও তা রান্নার উপযোগী ছিল না। তাই দোকান থেকে ইফতার সামগ্রী কিনে তাদের ইফতার করতে হয়েছে।
গ্যাস না থাকায় দু’দিন ধরে বাড়ির উঠানে মাটির চুলায় রান্না করেছেন সবুজবাগের বাসিন্দা ফারজানা। তিনি বলেন, বাইরের খাবার কিনে খাওয়া যায় না। দামও বেশি। খেতেও ভালো লাগে না। এসব খাবার খেয়ে অসুস্থ হলে রোজা রাখা যাবে না। তাই কষ্ট করে মাটির চুলায় রান্না করছি। গ্যাস ছাড়া খুব সমস্যা হচ্ছে। সবকিছু রান্না করাও যায় না। শুধু ভাত আর তরকারি রান্না করছি। রোজার জন্য কোনো খাবার বানাতে পারছি না। বাসাবো কদমতলা এলাকায় থাকেন নূরনাহার। তিনি বলেন, আজ সকাল থেকে গ্যাস নেই। গতকালও সারাদিন ছিল না। বাইরে থেকে ইফতার কিনে খেয়েছি। সেহ্রির জন্যও বাইরে থেকে খাবার কিনে রেখেছিলাম। আজকেও একই অবস্থা। কখন গ্যাস আসবে জানি না। রোজার মধ্যে গ্যাস, পানি না থাকলে খুব ঝামেলা। মিরপুর পাইকপাড়ার বাসিন্দা জনি মিয়া বলেন, গতকাল থেকেই গ্যাসের সমস্যা হচ্ছে। চুলা নিভু নিভু করে জ্বলছে। যেভাবে চুলা জ্বলছে, তা দিয়ে রান্না করার মতো কোনো অবস্থা নেই। গতকাল ভোররাতে সেহ্রির আগে ভাত রান্না করতে পারিনি। এজন্য আধাসিদ্ধ ভাত পানি ঢেলে খেতে হয়েছে। তরকারিও রান্না করতে না পারিনি। ইফতারির সময়ও একই সমস্যা পোহাতে হয়েছে। এজন্য দোকান থেকে ইফতারি কিনতে হয়েছে। টাকা দিয়ে গ্যাস কিনে এমন সমস্যায় পড়তে হবে কেন?
খিলগাঁও মাটির মসজিদ এলাকার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, গ্যাসের খুব সমস্যা হচ্ছে। সন্ধ্যায় একটু একটু আসছিল কিন্তু তা দিয়ে রান্না হচ্ছে না। ইফতারে বাঙ্গি, তরমুজ, মালটা আর শরবত বানিয়ে খেয়েছি। রাত ১২টায় একটু গ্যাস আসছিল তখন শুধু ভাত আর আলু সিদ্ধ করে ভর্তা বানিয়ে খেয়েছি। বাংলামোটরে থাকেন বেসরকারি চাকরিজীবী সাব্বির আহমেদ। দু’দিন ধরে গ্যাস না থাকায় উষ্মা প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, সারাদিন অফিস করে রাতে এসে দেখি বাসায় গ্যাস নেই। রাত ১২টার পর সামান্য গ্যাস ছিল। কিন্তু তা দিয়ে রান্না করা সম্ভব হয়নি। তাই রাতে দু’জন মিলে পুরান ঢাকার হোটেলে গিয়ে ইফতার করতে হয়েছে। গ্যাস না থাকায় সেখানেও খুব ভিড়ের মধ্যে পড়তে হয়েছে। আমাদের মতো অনেকেই এসেছিলেন। কল্যাণপুর এলাকার বাসিন্দা শম্পা রেজা বলেন, অন্য সময় গ্যাস না থাকলে আগে থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়। এবার সেটা করা হয়নি। আমাদের ভবনের কেউই গ্যাস না থাকার বিষয়টি জানতেন না। ঢাকায় আমাদের অন্যান্য স্বজনদের বাড়িতেও গ্যাস নেই। সবার সমস্যা হয়েছে।
এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন সিএনজি স্টেশনেও দু’দিন ধরে গ্যাসের চাপ কম থাকায় বিড়ম্বনায় পড়েছেন যানবাহন চালকরা। সরজমিন ঘুরে বিভিন্ন স্টেশনে তাই গাড়ির দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। সিএনজি স্টেশন ছাড়িয়ে এই লাইন সড়কের জায়গাও দখল করে নিয়েছে। এতে সড়কের যানজট আরও তীব্র হয়েছে। যানবাহন চালকরাও গ্যাসের সংকটে অতিষ্ঠ হয়েছেন।
গতকাল সকালে তেজগাঁওয়ের নাবিস্কো এলাকার সিএনজি স্টেশনে গ্যাস নিতে গেলে মাত্র ১৩ টাকার গ্যাস পেয়েছেন সিএনজিচালক মো. আজাহার। এরপর সেখান থেকে মুগদা এসে দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করে মাত্র ৮০ টাকার গ্যাস নিয়েছেন তিনি। আজাহার বলেন, আমার ২৫০ টাকার গ্যাস লাগে। কিন্তু এত অপেক্ষা করে মাত্র ৮০ টাকার গ্যাস পাইলাম। এটা দিয়া বেশিক্ষণ চালানো যাইব না। মো. মিজান নামের এক চালক বলেন, কালকে অনেক কষ্টে দুই ঘণ্টা দাঁড়াইয়া গ্যাস নিছি। অন্যসময় ১০ মিনিটও লাগে না। আজকেও সিরিয়ালে দাঁড়াই রইছি। অনেক সময় লাগবে। ওবায়দুল সরকার নামের আরেক চালক বলেন, অনেক জায়গায় গ্যাস পাই নাই। বন্ধ করে রাখছে। এখানে দুইবার গ্যাস দেয়ার পরেও ৭৮ টাকার গ্যাস পাইছি। এটা দিয়া সারা দিন ক্ষ্যাপ মারতে পারমু না। মুগদা সিএনজি স্টেশনে দায়িত্বরত মুক্তার হোসেন জানান, দুইদিন ধরে গ্যাসের চাপ খুব কম। এক গাড়িকে কয়েকবার গ্যাস দিয়েও পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এতে যানবাহনের চাপ খুব বেড়েছে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় তাদের চারটি মেশিনের মধ্যে তিনটি বন্ধ রাখতে হয়েছে। একটি দিয়েও তেমন গ্যাস আসছে না। এতে তাদের উপরেও খুব চাপ পড়ছে।