নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের ৬ মাসের কারাদন্ড

টেমসসুরমাডেক্স: ইংরেজি নতুন বছরের প্রথম দিনে আদালতে দণ্ডিত হলেন বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের দায়ের করা মামলায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ৪ জনকে ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। গতকাল দুপুরে ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক  বেগম শেখ মেরিনা সুলতানা এই রায় ঘোষণা করেন। দণ্ড পাওয়া অপর তিন জন হলেন- গ্রামীণ টেলিকমের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আশরাফুল হাসান, পরিচালক নুরজাহান বেগম ও মো. শাহজাহান। রায়ের পর আসামি পক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে আপিলের শর্তে এক মাসের জন্য ড. ইউনূসের জামিন মঞ্জুর করেন আদালত। 

আদালতে ড.  ইউনূসের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, খাজা তানভীর আহমেদ ও এসএম মিজানুর রহমান। অপরদিকে কলকারখানা পক্ষে ছিলেন এডভোকেট খুরশীদ আলম খান।

ড. ইউনূসের মামলার রায় ঘোষণার সময় শ্রম আদালতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, খ্যাতিমান আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, সমাজকর্মী রেহনুমা আহমেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া বিদেশি পর্যবেক্ষক ও অধিকার কর্মীরাও রায় শুনতে আদালতে উপস্থিত ছিলেন। 
রায়ে শ্রম আইনের ৩০৩ (ঙ) ধারায় সর্বোচ্চ ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ১০ দিনের কারাদণ্ড দেয়া হয়। অপরদিকে ৩০৭ ধারায় ২৫ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ১৫ দিনের কারাদণ্ড দেন আদালত। 

রায়ের পর আসামিপক্ষ আপিলের শর্তে জামিন আবেদন করেন। আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করে ৫ হাজার টাকা বন্ডে এক মাসের জন্য জামিন দেন। এই সময়ের মধ্যে শ্রমিকদের ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন করে যেসব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, তা বিধি সংশোধন করে সেসব সুবিধা প্রদান করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

এর আগে দুপুর ১টা ৪৩ মিনিটে এজলাসে এসে পৌঁছেন ড. ইউনূস। এজলাসের দ্বিতীয় সারির বেঞ্চে বসে রায় শুনেন তিনি।
রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আদালত ও এর আশপাশ এলাকায় পুলিশের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। 
রায়ের পর ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, লেবার কোর্টের ইতিহাসে এত তাড়াতাড়ি শুনানি দেখিনি। এক মাসে ৯/১০টা ডেট দিয়েছেন। ১৫ দিনের জন্য আইনজীবীদের ছুটি দেয়া হয়েছে। এখনো কোর্টের এজলাস তৈরি করা হয়নি। নিজেরা এজলাস তৈরি করে এখানে তড়িঘড়ি করে শুনানি করে সাজা দেয়া হয়েছে। আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, এই রায়ে আমরা বিক্ষুব্ধ। এই রায় অন্যায়, এই রায় জনগণের বিরুদ্ধে এবং আইনবিরোধী। আমরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। তাই আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবো। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ কোনো কিছুই প্রমাণ করতে পারেনি। আমরা ১০৯টা কন্ট্রাডিকশন (অসঙ্গতি) দিয়েছি। একটা দিলেই তো খুনের আসামি পর্যন্ত জামিন পেয়ে যায়। সেখানে ১০৯টা অসঙ্গতি দেয়া হলেও আদালত আমলে নেয়নি। আইন অনুযায়ী এক বছরের নিচে সাজা হলে আপিলের শর্তে জামিন দিতে হয়। আমরা আপিলের শর্তে জামিন নিয়েছি। আমরা নির্দিষ্ট সময়ে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে আপিল করবো। 

আইনজীবী বলেন, নিয়ম হচ্ছে ওপেন কোর্টে পূর্ণাঙ্গ জাজমেন্ট দেয়া। যখনই দেখা গেল তার জাজমেন্টে প্রতি লাইনে ভুল! তখন তিনি লাইনে ভুল বাদ দিয়ে সরাসরি জাজমেন্ট না পড়ে আদেশ দিয়েছেন। নিয়ম হচ্ছে আসামিপক্ষকে পূর্ণাঙ্গ জাজমেন্ট পড়ে শোনানো।  তিনি আরও বলেন, উনি নাকি শ্রমিকদের স্থায়ী করেননি। অথচ আইনে আছে একজন শ্রমিকের নিয়োগের ৬ মাস হয়ে গেলে অটোমেটিক্যালি তিনি স্থায়ী হয়ে যাবেন। এটা শ্রম আইনে উল্লেখ আছে। আর এই অভিযোগেই তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।

ওদিকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পক্ষের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান। তিনি বলেন,  প্রমাণিত হয়েছে  বাংলাদেশে আইনের শাসন আছে। যে যত বড় হোক, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। গ্রামীণ টেলিকম শ্রম আইনের পরিবর্তে নিজস্ব আইন অনুসরণ করেছে। খুরশিদ আলম বলেন, আপনি যখন প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন শ্রম আইনের অধীনে, শ্রম আইন মানতে হবে। আপনি নোবেল লরিয়েট, তার মানে এটা নয়, আপনি আইন মানবেন না। খুরশিদ আলম বলেন, দালিলিক সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর যে মামলা করেছিল, সেটি আমরা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। 

রায়ের পর প্রতিক্রিয়া: 
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক মহাসচিব ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মানবাধিকার কর্মী আইরিন খান বলেন, সাজার রায়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের কোনো অসম্মান হবে না। আন্তর্জাতিক বিশ্বে তার সম্মান অটুট থাকবে। বরং তার বিরুদ্ধে রায়ের ফলে দেশেরই অসম্মান হবে, দেশের বিচার ব্যবস্থার অসম্মান হবে। তিনি বলেন, ড. ইউনূসকে পৃথিবীর সবাই ভালো করে চেনে। তিনি কী কাজ করেন তা ভালো করে জানে। তাই সাজার রায়ে ড. ইউনূসের অসম্মান হবে না। তিনি বলেন, বছরের প্রথম দিনে আমরা সবাই স্বপ্ন দেখি বছরটা কেমন যাবে। আমি আশা করি সরকার মানুষের মানবাধিকারের বিষয়ে সচেতন হবে এবং মানুষের মানবাধিকার রক্ষা করবে। মিথ্যা বিচার করে এবং মিথ্যা কেস এনে কারও লাভ হয় না… শুধু আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে অসম্মান করা হয়। তিনি আরও বলেন, বিদেশের কেউ ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে প্রশংসা করছেন না। বরং সবাই নিন্দা করছেন। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সরকারকে আগে থেকেই অনুরোধ করেছেন যেন ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে এই চার্জগুলো না আনা হয়। এটা যোগ্য কেস নয়। সরকার সে অনুরোধ শোনেনি। 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, আমরা এখানে সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে এসেছি স্যারের প্রতি সংহতি জানাতে। আমরা মনে করি, ড. ইউনূসের বিচার চলাকালে এবং এর আগে ক্ষমতায় সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে উনার বিরুদ্ধে জঘন্য মিথ্যাচার ও অপপ্রচার করা হয়েছে। যেভাবে শ্রম আদালত বসেছে, অস্বাভাবিক ঘন ঘন শুনানি হয়েছে। অস্বাভাবিক দ্রুততায় রায় হয়েছে। আমাদের সন্দেহ আছে, এটা ন্যায়বিচার হয়েছে কিনা? আমাদের সন্দেহ রয়েছে। আর স্যারের প্রতি সংহতি জানাতে এবং বাংলাদেশের মানুষের স্যারের প্রতি যে ভালোবাসা আছে, সেটার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য আমরা এখানে উপস্থিত হয়েছি।

এবি পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, এই বিচারিক প্রক্রিয়া বা যে কারণে করা হচ্ছে তা কোনোভাবে ফৌজদারি প্রকৃতির কোনো বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়েই না। এটা সর্বোচ্চ দেওয়ানি প্রকৃতির মধ্যে পড়তে পারে। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে তার সাজা বা বিচার কোনো কিছুই হওয়া উচিত নয়। আদালতের কার্যক্রম চলার সময় বাইরে ড. ইউনূসের পক্ষে সংহতি প্রকাশ করে ও সমর্থন জানিয়ে অবস্থান নেন আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) নেতাকর্মীসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। রায় ঘোষণার আগে পরে তারা বিভিন্ন স্লোগান দেন। 

২০২১ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক আরিফুজ্জামান ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে ইউনূসসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে এ মামলা  করেন। এতে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে নির্দিষ্ট লভ্যাংশ জমা না দেয়া, শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী না করা, গণছুটি নগদায়ন না করায় শ্রম আইনের ৪-এর ৭, ৮, ১১৭ ও ২৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে। মামলা বাতিলের আবেদন নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতেও গিয়েছিলেন ড. ইউনূস। কিন্তু গত মে মাসে তার আবেদন আপিল বিভাগে খারিজ হয়ে যায়। এরপর ২০২৩ সালের ৬ই জুন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক বেগম শেখ মেরিনা সুলতানা। গত ২২শে আগস্ট থেকে এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। বাদীসহ ৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ৮ই নভেম্বর আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য দেন আসামিরা। ২৪শে ডিসেম্বর চলে দুইপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্কের আইনি বাহাস। ইতি টানা হয় ১১ কার্যদিবসের শুনানির, যা শুরু হয়েছিল ২১শে নভেম্বর।

error: