টেমসসুরমানিউজডেক্স: সিলেট ও সুনামগঞ্জে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বন্যা পরিস্থিতি। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ শহরের অবস্থা সব চেয়ে বেশি খারাপ। রাস্তাঘাট ডুবে যাওযায় কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সুনামগঞ্জ। অফিস আদালত, বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। মানুষজন পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এদিকে ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলে কুড়িগ্রামে ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এ অবস্থায় এসএসসি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
সিলেট ও সুনামগঞ্জের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সব চেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা সুনামগঞ্জ শহরে। এখানে অফিস আদালত, বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ পুরো শহর বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বন্যায় সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের গোবিন্দগঞ্জ-দিঘলী এলাকা প্লাবিত হয়ে সারাদেশের সঙ্গে সুনামগঞ্জের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে আন্তঃজেলা যোগাযোগ ব্যবস্থাও। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। কার্যত এখানকার লোকজন এখন গৃহবন্দি।
আকস্মিক বন্যায় সিলেট নগরের উপশহর, সোবহানীঘাট, মেন্দিবাগ, মুরাদপুর এবং নদী তীরবর্তী এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তাই গ্রাহকদের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে জরুরি সতর্কবার্তা দিয়েছে সিলেট বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ। আর সিলেটে পর্যাপ্ত নৌকা ও উদ্ধারকর্মী না থাকায় পানিতে আটকেপড়া মানুষ উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের হাতে পর্যাপ্ত নৌকা ও উদ্ধার সরঞ্জামাদি না থাকায় জেলা প্রশাসক সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চেয়েছেন।
শুক্রবার সকালে জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারসহ সার্বিক সহযোগিতা চেয়ে ১৭ পদাতিক ডিভিশন সিলেটের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং বরাবর চিঠি পাঠিয়েছেন।
জানা গেছে, দুই জেলার অন্তত ১৫ উপজেলা বন্যা কবলিত। সিলেটের পাঁচ লক্ষাধিক লোক পানিবন্দি। সিলেট শহরের আনাচকানাচেও পানি। শুক্রবার সকাল ৯টায় এ রিপোর্ট লেখার সময়ও প্রবল বর্ষণে সিলেটের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
সুনামগঞ্জের সঙ্গে সারাদেশের সড়ক পথের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন রয়েছে বলে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানিয়েছেন। তিনি জানান, বন্যার পানিতে সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের ছাতক উপজেলার গোবিন্দগঞ্জ-দিঘলী এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। সেখান দিয়ে কোনো দূরপাল্লার গাড়ি আপাতত যেতে পারবে না। তবে ছোট যানবাহন, মোটরসাইকেল চলতে পারবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাইড্রোলজি বিভাগ জানায়, সুনামগঞ্জের ছাতক তাহিরপুর, দোয়ারাবাজার, সিলেটের জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাটের উজানে, মৌলভীবাজারের মনু রেলব্রিজ ও শ্রীমঙ্গলে বৃষ্টিপাত আরও বেড়েছে। জৈন্তাপুর উপজেলার লালাখাল, গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং এবং ভারতের আসাম ও চেরাপুঞ্জি এলাকায় ভারি বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় পানি আরও বাড়বে।
পাউবো হাইড্রাওলজি বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সত্যেন্দ্র চন্দ বৈদ্য ঢাকা টাইমসকে জানান, শুক্রবার সকাল ৯টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় সিলেট বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে সুনামগঞ্জে। সেখানে ৩৭৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
এছাড়া সুনামগঞ্জের ছাতকে ৩৬৫ মিলিমিটার আর লাউড়ের গড়ে ৩২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
অপরদিকে সিলেটের জাফলংয়ে ২৬৮ মিলিমিটার আর লালা খালে ১৪৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টায় সিলেট সার্কিট হাউসে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মুজিবুর রহমান। জেলার বিভিন্ন উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান ও বিভিন্ন ইউপি চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বিভাগীয় কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সভা শেষে জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সিলেটের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি এখন খুবই ভয়াবহ। মহানগরীর অধিকাংশ এলাকা এবং কমিবেশি ১৩টি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে ভয়াবহ পরিস্থিতি গোয়াইনঘাট, সিলেট সদর, কোম্পানিগঞ্জ ও জৈন্তাপুর উপজেলায়।’
দুর্যোগ মোকাবেলায় কমিটির সভায় ব্যাপক আলোচনা শেষে বিভিন্ন কৌশল নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি গোয়াইনহাট উপজেলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়।
এদিকে সিলেটে বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-২–এর নির্বাহী প্রকৌশলী শামস-ই আরেফিন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আকস্মিক বন্যার কারণে উপশহর, সোবহানীঘাট, মেন্দিবাগ, মুরাদপুর এবং আশপাশের এলাকা প্লাবিত হয়েছে। যে কারণে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে পানিতে কোনো বৈদ্যুতিক তার, খুঁটি বা অন্যান্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি পড়ে থাকলে কিংবা গাছপালা বৈদ্যুতিক লাইনে পড়লে স্পর্শ না করে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দ্রুত বিউবো বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-২–এর দপ্তরে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।
এদিকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সিলেটের ১৩টি উপজেলার পাঁচটি পৌরসভা ও ১০৫টি ইউনিয়নের সার্বিক ত্রাণ কার্যক্রম তুলে ধরা হয়।
সিলেট জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সিলেটের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়নের জন্য চার টন করে এবং অন্যগুলোতে দুই টন করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। ১৫ জুন পর্যন্ত সিলেট জেলায় মোট ২৯৮ টন এবং ১৬ জুন ১৩৪ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায় ৫০০ ব্যাগ/ বস্তা, গোয়াইনঘাট উপজেলায় ১০০০ ব্যাগ/বস্তা, সিলেট সদর ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ৭০০ ব্যাগ/বস্তা করে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়।
ত্রাণ কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম জানান, গোয়াইনঘাট উপজেলার জন্য নগদ পাঁচ লাখ টাকা, সিলেট সদর উপজেলার জন্য তিন লাখ টাকা, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার জন্য দুই লাখ টাকা এবং জৈন্তাপুর উপজেলায় এক লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বৃহস্পতিবার দিন পর্যন্ত ২৯৮ টি আশ্রয় কেন্দ্র চালু ছিল এখন তা আরও বাড়বে।’
স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, নগরীর তালতলা, মির্জাজাঙ্গাল, শেখঘাট, কাজিরবাজার, মাছিমপুর, উপশহরসহ নীচু এলাকায় হাঁটুর ওপরে পানি। অনেক বাসাবাড়িতে সুপেয় পানির অভাব দেখা দিয়েছে।
গোয়াইঘাটের সিনিয়র সংবাদকর্মী মিনহাজ উদ্দিন জানান, পুরো উপজেলা এখন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। রাস্তাঘাট তলিয়ে আছে। বাড়িঘরে কোমর পর্যন্ত পানি।
সিলেটের সিনিয়র রিপোর্টার দিপু সিদ্দিকী শহর ঘুরে জানান, সিলেট জেলা ও নগরীর বর্তমান পরিস্থিতি আগের বন্যার চেয়ে খারাপ।