চলচ্চিত্র অভিনেত্রী পরীমণিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে সাভার থানায় দায়ের করা মামলায় ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও তুহিন সিদ্দিকী অমিকে জামিন দিয়েছেন আদালত। আসামিপক্ষের আইনজীবী আদালতে শুনানিকালে বলেছেন, পরীমণি নিজেই মদ খেয়ে অপকর্ম করার চেষ্টা করেছেন।
এদিন আদালতে আসামিপক্ষের আইনজীবী হিসেবে ছিলেন এ এইচ ইমরুল কাউসার, আমানুল করিম লিটন, জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়াসহ আরও অনেকে। তারা আসামিদের জামিনের আবেদন করেন৷ অপরদিকে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর শেখ হেমায়েত হোসেন, সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্তি পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবীর বাবুল আসামিদের জামিনের বিরোধিতা করেন।
এদিন শুনানিতে আসামিপক্ষের আইনজীবী এ এইচ ইমরুল কাউসার বলেন, ‘পরীমণি পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এ কাজটি করেছেন। এ ঘটনার সঙ্গে আসামিরা জড়িত নন। ওই ক্লাবে রাত তিনটা পর্যন্ত কী করলেন, সেই ব্যাখ্যা এজাহারে নেই। তিনি (পরীমণি) মদ খেয়েছেন টেলিভিশনের ভিডিও ফুটেজে আছে। দাঁত ভেঙে গেছে, ঠোঁট ফেটে গেছে, পায়ে লেগেছে, সেই লোক কীভাবে মদ খায়? এখানে বাড়তি কথার সুযোগ নেই।’
ইমরুল কাউসার বলেন, ‘আমার আসামি নাসির উদ্দিন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। উনি উত্তরা ক্লাবে কয়েকবার নির্বাচিত হয়েছেন। ৬৫ বছরের একজন বয়স্ক লোক, উনার দ্বারা এই কাজ করা সম্ভব? ঘটনার ৪ দিন পরে পরীমণির মামলা রুজু হয়েছে। উনি আগে মিডিয়ার অ্যাডভান্টেজ নিয়ে মামলা করেছেন। পরে মিডিয়া সেই ভুল বুঝতে পেরেছে। আসামি অসুস্থ মানুষ। দুই বারে তাকে মোট ১২ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। নতুন তথ্য বের হয়নি। আসামি জামিন পেলে পলাতক হবেন না। করোনার মধ্যে সকলের অবস্থা খারাপ, সেখানে জেল হাজতের অবস্থা কী? তাই যে কোনও শর্তে আসামি নাসির উদ্দীনের জামিনের প্রার্থনা করছি, স্যার।’
আসামি অমির পক্ষের আইনজীবী বলেন, ‘‘আসামি অমি পরীমণিকে বলেছিলেন, আমি এই ক্লাবে যাচ্ছি তুমি নামতে পারো।’ এখানে পরীমণিকে কোনও প্রকার জোর করা হয়নি। তার বোনের কথা বলে তিনি নিজেই গেছেন। ভিকটিমের শরীরের কোনও স্পর্শকাতর জায়গাও স্পর্শ করেননি। পরীমণিকে আসামিরা কোনও আঘাত করেননি। আসামি অমি তাকে মদ পান করাননি। এমন কথা এজাহারেও উল্লেখ নেই। উনি নিজেই মদ খেয়ে অপকর্ম করার চেষ্টা করেছেন। আসামি অমি একজন ব্যবসায়ী লোক। আসামির ডায়বেটিস, হাঁটতে পারেন না। অ্যাজমাও আছে। উনি অসুস্থ।’’ তাই যে কোনও শর্তে তার জামিনের প্রার্থনা করেন তার আইনজীবী।
শুনানিতে সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্তি পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবীর বাবুল আসামিদের জামিনের বিরোধিতা করে বলেন, ‘মামলাটি দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্রপক্ষ মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই। মামলার বিষয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তদন্ত কর্মকর্তা যে বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে বাধ্য নন, তিনি তা উহ্য রেখেছেন। আসামিরা প্রভাবশালী, জামিনে গেলে মামলার ওপরে প্রভাব পড়তে পারে।’
এরপর শুনানিতে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর শেখ হেমায়েত হোসেন বলেন, ‘আসামিরা জামিনে বাইরে থাকলে মামলার তদন্তে ক্ষতি হতে পারে। এজন্য তাদের জামিন নামঞ্জুরের প্রার্থনা করছি। এরপর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের পুলিশ পরিদর্শক মেজবাহ উদ্দিন শুনানির মাঝে বলেন, ‘মামলা তদন্তের স্বার্থে প্রভাব মুক্ত রাখতে আসামিদের জেল হাজতে রাখা দরকার।’ এরপর উভয়পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক আসামিদের পাঁচ হাজার টাকার মুচলেকায় পরবর্তী ধার্য তারিখ ৮ জুলাই পর্যন্ত জামিনের আদেশ দেন।
শুনানি শেষে আসামিপক্ষের আইনজীবী জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘আদালত বিষয়টি অবজার্ভ করেছেন। একটা অভিযোগ দিলেইতো হবে না। অভিযোগের সাপোর্টিং এভিডেন্স থাকতে হবে। মেডিক্যাল এভিডেন্স সেখানে ছিল না। আদৌ যে পরীমণির মুখে মদের বোতল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, এ বিষয়টি যদি বাস্তবে হয়েও থাকতো, তাহলে পুলিশ ইন্টারোগেট করতো এবং এটার একটা রিপোর্ট থাকতো। এ বিষয়ে কোনও তথ্যাদি আদালতে এখনও পর্যন্ত নেই।’
ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদের আইনজীবী মো. আমানুল করিম লিটন বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে যে মাদকের মামলাটি রয়েছে, সেটিতে জামিন পেলে তারা মুক্তি পাবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘নাসির সাহেব একজন অমায়িক বয়স্ক লোক। উনাকে আমি দীর্ঘদিন ধরে চিনি। তিনি এ জাতীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এটা কখনোই শুনিনি, বুঝিওনি। অন্যায়ের যে পরাজয় হয়, ন্যায়ের যে জয় হয়, সেটা আজ আদালতে আবারও প্রমাণ হলো। নাসির উদ্দিনের যে জামিনটা দিয়েছেন, উনি একজন বিবেচক আদালত। উনি বুঝতে পেরেছেন যে, এই মামলাটি ফলস অ্যান্ড ফেব্রিকেটেড। এখানে কোনও মেডিক্যাল সার্টিফিকেট নেই, কিচ্ছু নেই।’ তিনি বলেন, ‘৯ এর ৪ ধারায় মামলা হতে হলে যে এলিমেন্টসগুলো থাকতে হয় তার কিছুই এই মামলায় নেই। তারপরও তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল, জিজ্ঞাসাবাদে কিছুই পাওয়া যায়নি। আজ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও শুনানিতে সন্তুষ্ট হয়ে তাদের জামিন দিয়েছেন বিচারক।’
ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী উল্লেখ করে এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘তার মতো এমন বিশিষ্ট ভদ্রলোক এখনকার সমাজে খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্টকর এবং সেই লোকটাকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার জন্য এমন একটা কাজ করা হয়েছে। এটা গর্হিত কাজ করা হয়েছে, অন্যায় করা হয়েছে এবং সেই অন্যায়ের সঠিক বিচার আমরা চাই। রাষ্ট্রপক্ষ যেমন বিচার চায়, আমরা আসামিপক্ষও বিচার চাই, সঠিক তদন্ত হওয়া দরকার। এই মামলাটির চূড়ান্ত রায় আসার পর বাদীর বিরুদ্ধে ২/১১ ধারায় মামলা হওয়া উচিত। যেন ভবিষ্যতে কেউ মিথ্যা মামলা করতে না পারে।’
উল্লেখ্য, গত ১৪ জুন ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও তুহিন সিদ্দিকী অমির নাম উল্লেখ করে মোট ছয় জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন চিত্রনায়িকা পরীমণি। সেই মামলায় উত্তরার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও তিন নারীর সঙ্গে তুহিন সিদ্দিকী অমিকেও গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।