ভারতে প্রেম ও ধর্মের লড়াইয়ে গর্ভের শিশু নষ্টের অভিযোগ

একজন অন্তঃসত্ত্বা হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত এক নারীকে জোর করে তার মুসলিম স্বামীর কাছ থেকে আলাদা করার পর তার গর্ভপাতের খবরে ভারতে নতুন ধর্মান্তরকরণ বিরোধী আইন নিয়ে বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।

চলতি মাসের শুরুর দিকে একটি ভিডিও ভারতের সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। তাতে দেখা যায়, উত্তর প্রদেশ রাজ্যের মোরাদাবাদ শহরে একদল পুরুষ একজন নারীকে হেনস্তা করছে। ওই পুরুষদের গলায় জড়ানো কমলা রঙয়ের উত্তরীয় ছিল। ওই ২২ বছরের নারীকে একজন পুরুষ বলছেন, ‘তোমার মতো লোকেদের জন্য বাধ্য হয়ে আইন আনতে হয়েছে’। হেনস্তাকরীরা বজরং দলের লোক। কট্টর হিন্দুত্ববাদী ওই দলটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজেপির সমর্থক।

যে আইনের কথা তারা বলছে, সেটা হলো উত্তর প্রদেশ রাজ্যে কথিত ‘লাভ জিহাদ’ আটকাতে অবৈধভাবে ধর্ম পরিবর্তনরোধে হওয়া নতুন এক আইনের অধ্যাদেশ।

মুসলমানরা পরিকল্পিতভাবে হিন্দু নারীদের বিয়ে করে ধর্মান্তরিত করছে বলে ভারতের কট্টরপন্থি বিভিন্ন হিন্দু সংগঠন দীর্ঘ দিন ধরে অভিযোগ করে আসছে। বিয়ের মাধ্যমে ধর্মান্তরিত করার ওই প্রক্রিয়াকে ‘লাভ জিহাদ’ বলে অ্যাখ্যা দিচ্ছেন তারা। তাদের চাপেই উত্তর প্রদেশে নতুন ওই ধর্মান্তররোধী আইন হয়েছে। যাকে সমালোচকরা ‘ইসলামোফোবিক আইন’ নামে অভিহিত করেছেন। শুধু উত্তর প্রদেশই নয়, ভারতের আরো অন্তত চারটি রাজ্যে ‘লাভ জিহাদ’ বিরোধী আইন পাসের চেষ্টা চালচ্ছে।

ভিডিওতে তোলা ওই ঘটনাটি ঘটেছে ৫ ডিসেম্বর। এতে দেখা যায় বজরং দলের সক্রিয় কর্মীরা ২২ বছরের ওই নারীকে হেনস্তার পর তাকে এবং তার স্বামী ও স্বামীর ভাইকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। পুলিশ এরপর ওই নারীকে পাঠিয়ে দেয় সরকারের একটি আশ্রয় কেন্দ্রে এবং তার স্বামী ও স্বামীর ভাইকে গ্রেফতার করে।

তবে ওই নারী আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটকে বলেন, তিনি প্রাপ্তবয়স্ক ও তিনি নিজের ইচ্ছায় ওই মুসলিম পুরুষকে বিয়ে করেছেন।

তিনি আরো বলেন, তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন ও তার মুসলিম স্বামীকে বিয়ে করেছেন জুলাই মাসে উত্তরাখন্ড রাজ্যের দেরাদুন শহরে। তারা যখন মোরাদাবাদে ফেরত আসেন, তখন তাদের ধরা হয় ও তাদের বিবাহ নথিভুক্ত করার জন্য চাপ দেয়া হয়।

আটকের সময় ওই নারী সাত সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ঘটনার কয়েক দিন পর ওই নারী অভিযোগ করেন, হেফাজতে থাকা অবস্থায় তার গর্ভপাত হয়েছে। এ সপ্তাহের শুরুতে, আদালত ওই নারীকে তার স্বামীর বাসায় ফিরে যাবার অনুমতি দেয়া হয়।

সোমবার ছাড়া পাবার পর ওই নারী সংবাদ মাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেন, সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রের কর্মচারীরা তার সাথে দুর্ব্যবহার করেছে ও তার পেটে ব্যথা হচ্ছে একথা বলার পরেও তাকে হাসপাতালে নেয়নি। অবশ্য আশ্রয়কেন্দ্র ওই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

তিনি আরো বলেন, ‘১১ ডিসেম্বর আমার অবস্থা যখন খুব খারাপ হয়, ওরা আমাকে একটা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে রক্ত পরীক্ষার পর, ওরা আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে ও আমাকে ইনজেকশান দেয়। এরপর আমার রক্তপাত শুরু হয়ে যায়। এর দু’দিন পর আমাকে আরো ইনজেকশান দেয়া হয়। রক্তপাত আরো বাড়তে থাকে এবং স্বাস্থ্যের অবনতি হয়।’ এর পর তার গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যায় বলে তিনি জানান।

এদিকে তখন তার গর্ভপাতের খবর আশ্রয়কেন্দ্রর কর্তৃপক্ষ নাকচ করে দিয়েছে।

শিশু সুরক্ষা কমিশনের সভাপতি ভিশেশ গুপ্তা গর্ভের ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যাবার সব খবর অস্বীকার করে বলেন, গর্ভের শিশুটি নিরাপদ আছে।

তবে যে হাসপাতালে ওই নারীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেখানকার একজন স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আলট্রাসাউন্ডে তারা সাত সপ্তাহের ভ্রূণটি দেখতে পেয়েছিলেন। এখন একমাত্র যোনিপথ দিয়ে আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করলে তবেই নিশ্চিতভাবে বোঝা যাবে, ভ্রূণ নিরাপদ আছে কিনা।’

ওই নারী আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ছাড়া পাবার পর করা যাবতীয় অভিযোগ নিয়ে কর্তৃপক্ষ এখনো কোনো মন্তব্য করেনি। তারা ওই নারীর আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষার ফল অথবা হাসপাতালে তাকে ইনজেকশানের মাধ্যমে কী ওষুধ দেয়া হয়েছিল ওই বিষয়ে কোনো বিস্তারিত তথ্য দেয়নি।

তাই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার পাঁচ দিন পরেও তার গর্ভের ভ্রূণ সম্পর্কে স্বচ্ছ কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ফলে ভ্রূণের অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ও সন্দেহ দানা বেঁধেছে।

তবে ওই নারীর গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে গিয়ে থাকতে পারে এমন খবরে ভারতে আবার ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে দোষারোপ করছে।
ভারতে দীর্ঘ দিন ধরে ভিন্ন ধর্মের মধ্যে বিয়েকে অনেক পরিবার ও সমাজ মাঝে বাঁকা চোখে দেখার সংস্কৃতি রয়েছে। অনেক পরিবারকে দেখা যায় এ ধরনের বিয়ে সমর্থন করে না।

তবে কেউ ধর্মান্তরিত হতে চাইলে সে ব্যাপারে জেলা কর্তৃপক্ষের অনুমতি চাইতে হবে বলে নতুন আইন প্রণয়ন করায় ব্যক্তি বিশেষের প্রেম ভালবাসার ও জীবনসঙ্গী বেছে নেয়ার নাগরিক অধিকারে রাজ্যের হস্তক্ষেপ করার এখন প্রত্যক্ষ একটা ক্ষমতা তৈরি হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

ধর্মান্তরকে অপরাধ সাবস্ত করে সর্বোচ্চ সাজা দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড করা হয়েছে। নতুন আইনে ওই অপরাধ জামিনযোগ্য নয়। উত্তর প্রদেশের পর অন্তত আরো চারটি বিজেপি শাসিত রাজ্য কথিত ‘লাভ জিহাদের’ বিরুদ্ধে একই ধরনের আইন প্রণয়নের জন্য খসড়া তৈরি করছে।

সমালোচকরা ওই আইনকে প্রতিক্রিয়াশীল এবং আক্রমণাত্মক বলে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন, ওই আইন তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে বিয়ে বন্ধ করার একটা অস্ত্র হিসেবে। মূলত মুসলিম পুরুষ ও হিন্দু নারীদের মধ্যে বিয়েকে লক্ষ্য করে। ওই আইন বাতিল করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়েছে।

আইনটির বিরুদ্ধে ১ ডিসেম্বর ২০২০ ভারতের ব্যাঙ্গালোরে নারী আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ করেছে। ওই বিতর্কিত আইন ২৯ নভেম্বর পাস হবার পর অল্প সময়ের মধ্যে অন্তত ছয়টি ঘটনার ক্ষেত্রে আইনটি প্রয়োগ করা হয়েছে।

মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যেখানে বিয়েতে বর ও কনে দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক ও বিয়েতে তাদের দু’জনের মত রয়েছে এমনকি পরিবারেরও কোনো অমত ছিল না ওই সব বিয়েও বন্ধ করে দেয়া হয়। আর সবগুলো ঘটনায় মুসলিম পাত্রকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

‘এ ধরনের একটা আইনের সমস্যা হল যে, এতে দুই ধর্মের মধ্যে প্রেম বা বিয়ে হলে সেটাকে অপরাধী কার্যকলাপের পর্যায়ে ফেলা হচ্ছে’, বলছেন ঐতিহাসিক চারু গুপ্তা।

তিনি আরো বলেন,’মেয়েদের নিজেদের ইচ্ছা বলে যে একটা জিনিস থাকতে পারে, ওই আইনে সেই সম্মান দেয়া হয়নি। একজন নারী কাকে বিয়ে করবে সেই সিদ্ধান্ত নেবার বা পছন্দর অধিকার কি তার নেই? আর তার জন্য তাকে যদি আরেকটা ধর্ম গ্রহণ করতে হয়, সে চাইলে তাতে সমস্যা কোথায়?’

সূত্র : বিবিসি

error: