কোর্ট অব আপিলের রায়: অনায্য মালিকানা দাবীর মামলায় ‘শেফ অনলাইন’র বিজয়

যুক্তরাজ্যে গৌরবের সঙ্গে ‘শেফ অনলাইন’ নামে ব্যবসা পরিচালনা করা ‘লে শেফ পিএলসি’ দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে চলা একটি চ্যালেঞ্জিং মামলায় চূড়ান্তভাবে জয়লাভ করেছে। একই মামলায় রেস্টুরেন্ট খাতের জনপ্রিয় এওয়ার্ডস শো ‘আরতা’র লগো ও ট্রফির নকশার মেধাস্বত্ব (ইন্টেল্যাকচ্যুয়াল প্রোপার্টি রাইটস) নিয়ে তোলা অন্যায্য দাবিটিও খারিজ করে দিয়েছে আদালত।

গত ১৪ ফেব্রুয়ারি আপিল আদালতের (কোর্ট অব আপিল) সিদ্ধান্তে ইতিপূর্বে দেয়া হাইকোর্টের রায়কে বহাল রাখায় লে শেফ পিএলসি’র শেয়ার হস্তান্তর এবং আরতা’র লগো ও ট্রাফি নকশার মেধাস্বত্ব নিয়ে তোলা অন্যায্য অভিযোগের অবসান ঘটলো।

প্রসঙ্গত, ‘লে শেফ পিএলসি’ অনলাইন অর্ডারিং প্ল্যাটফর্ম ‘শেফ অনলাইন’ নামে ব্যবসা পরিচালনা করে। শেফ অনলাইন-এর সহযোগী হিসেবে রেস্টুরেন্ট ও টেকওয়ে খাতের সেরাদের নিয়ে জমজমাট এওয়ার্ডস অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আরতা এওয়ার্ডস লিঃ। ‘এশিয়ান রেস্টুরেন্টস অ্যান্ড টেকওয়ে এওয়ার্ডস’ নামের অনুষ্ঠানটি সংক্ষেপে ‘এআরটিএ বা আরতা’ নামে পরিচিত। লে শেফ পিএলসি ও আরতার ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিলেতে ব্যবসায়ী কমিটির পরিচিত মুখ মোহাম্মদ আব্দুল মুনিম (সালিক)।

২০১৬ সালে ‘গভর্নমেন্ট এন্টারপ্রাইজ ইনভেস্টমেন্ট স্কিম’ (ইআইএস) ‘লে শেফ পিএলসি’র বাজারমূল্য ১০ মিলিয়ন পাউন্ড বলে মূল্যায়ন করে। তারপর থেকে শেফ অনলাইন এবং আরতা- উভয় প্রতিষ্ঠান সাফল্যের সঙ্গে সমৃদ্ধির পথে এগিয়েছে। 

হাজিফুর রহমান এবং রিফাত আহমেদ নামে দুজন ব্যক্তি ২০২০ সালে লে শেফ পিএলসি এবং এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মুনিমের বিরুদ্ধে বেআইনি শেয়ার স্থানান্তরের অভিযোগ এনে আদালতে যান। ‘আরতা’র অফিসিয়াল লগো ও ট্রফির নকশার মেধাস্বত্ব দাবি করে আরতা এওয়ার্ডস লিঃ এর বিরুদ্ধে ভিন্ন একটি অভিযোগও দায়ের করেন হাফিজুর রহমান। সবকটি অভিযোগের একসঙ্গে শুনানী করে যুক্তরাজ্যের হাইকোর্টের ‘বিজনেস অ্যান্ড প্রোপার্টি’ বিভাগের ‘ইন্টেলেকচ্যুাল প্রোপার্টি লিস্ট’ বিভাগ। হাইকোর্টের বিচারক জার্ম্যান কেসি’র নেতৃত্বে ২০২০ সালের ২৪ থেকে ২৭ অক্টবর চার দিনব্যাপী এ শুনানী অনুষ্ঠিত হয়।

আদালত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম গঠনের আলোচনা, শেফ অনলাইনের সূচনা ও বিকাশের সাথে জড়িত প্রতিটি পক্ষের অবদানের পাশাপাশি ‘আরতা অ্যাওয়ার্ডস লিঃ’ এর লোগো এবং ট্রফি ডিজাইন নিয়ে উপস্থাপিত দালিলিক সাক্ষ্য-প্রমাণগুলো বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করে। ২০২২ সালের ২১ নভেম্বর ঘোষিত রায়ে হাইকোর্টের বিচারক জার্ম্যান কেসি উভয় অভিযোগাকারী- হাফিজুর রহমান এবং রিফাত আহমেদের আবেদন খারিজ করে দেন এবং লে শেফ পিএলসি ও এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল মুনিমের পক্ষে রায় দেন। একই রায়ে হাফিজুর রহমান কর্তৃক আরতা এওয়ার্ডসের লগো ও ট্রফি নকশার মেধাস্বত্ব দাবিটিও খারিজ করে দেয় আদালত। ওই মেধাস্বত্ব আরতা এওয়ার্ডস লিঃ এর বলে রায় দেয়।

কোম্পানির শেয়ার হস্তান্তরের বৈধতা এবং মেধাস্বত্ব দাবির বিষয়ে হাইকোর্টের দেয়া সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে কোর্ট অব আপিলে আবেদন করেন হাফিজুর রহমান। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে আপিল আদালত মেধাস্বত্ব দাবির বিষয়ে আপিলের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে দেন। এর ফলে তখন-ই চূড়ান্ত হয়ে যায় আরতা এওয়ার্ডসের লোগো বা ট্রফি নকশার উপর হাফিজুর রহমানের কোনো স্বত্বাধিকার বা কপিরাইট নাই।

আর কোম্পানির শেয়ার স্থানান্তরের বৈধতা নিয়ে আপিল গ্রহণ করায় এনিয়ে গত ৩১ জানুয়ারি আপিল আদালতে শুনানী অনুষ্ঠিত হয়। আপিল আদালতের তিন বিচারক- লেডি জাস্টিস কিং, লর্ড জাস্টিস বার্স এবং লেডি জাস্টিস ফক এর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই আপিলের শুনানী করে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি আপিল আদালতের রায়ে তিন বিচারক সর্বসম্মতিক্রমে হাইকোর্টের দেয়া মূল রায়কে বহাল রাখেন এবং আপিলটি খারিজ করে দেন। এরমধ্যে দিয়ে দীর্ঘ চলমান এই আইনী লড়াইয়ে লে শেফ পিএলসি, এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল মুনিম এবং আরতা এওয়ার্ডস লিঃ চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করলো।

কোর্ট অব আপিলের রায়ে লেডি জাস্টিস ফক বলেন, ‘জনাব রহমানের কোম্পানির শেয়ার হস্তান্তর নিয়ে হাইকোর্টের বিচারক জার্ম্যান কেসি যেসব প্রমাণ সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সেই সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমি সন্তুষ্ট।’

হাইকোর্টের দেয়া ২২ পাতার দীর্ঘ রায়ে বিচারক জার্ম্যান কেসি বাদীদের অভিযোগ খারিজ করে কোম্পানির পক্ষে রায় দেয়ার বিস্তারিত কারণ উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘দীর্ঘ ব্যবসায়িক ঘটনা প্রবাহের বর্ণনায় লে শেফ পিএলসি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মুনিমের বক্তব্য তাঁর কাছে অধিকতর সঠিক মনে হয়েছে।’

আরতা এওয়ার্ডস লিঃ এর লগো ও ট্রফির নকশা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে বিচারক জার্ম্যান কেসি রায়ে উল্লেখ করেন, ‘লে শেফ কোম্পানিতে কাজের বিনিময়ে হাফিজুর রহমান ইনভয়েসের মাধ্যমে মাসিক ১৫শ পাউন্ড করে বেতন নিতেন। নিজেকে সেল্প এমপ্লয়েড দাবি করলেও তিনি স্বীকার করেছেন যে তিনি কখনো সেল্প এমপ্লয়েড ট্যাক্স রিটার্ণ দাখিল করেননি বা এই অর্থের ওপর ট্যাক্স প্রদান করেননি।’ রায়ে আরো উল্লেখ করা হয়, হাফিজুর রহমান নিজের ছুটির জন্য কোম্পানির কাছে আবেদন করেছিলেন। তিনি কোম্পানির কাছে বেতন বৃদ্ধি এবং একটি গাড়ির আবেদনও করেছিলেন। যা প্রমাণ করে তিনি কোম্পানিতে চাকরি করতেন।

‘লে শেফ পিএলসি’, এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মুনিম এবং আরতা এওয়ার্ডস লিঃ এর পক্ষে মামলায় নেতৃত্ব দেন আইনজীবী ম্যাথিউ উইন-স্মিথ, ল্যাম্ব চেম্বার্স এন্ড সলিসিটর্স এর ডঃ টিমোথি স্যাম্পসন, লেক্সপার্ট সলিসিটর্স এলএলপি’র কেনেডি ওবিরোজি এবং মিসেস নাবিলা রফিক।

হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে আপিল আদালতের দেয়া সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় লে শেফ পিএলসি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মুনিম উভয় বিচারিক ব্যবস্থায় মামলাটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিবেচিত হওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “আমরা সন্তুষ্ট যে আপিল আদালত মূল রায়কে বহাল রেখেছে, শেয়ার স্থানান্তরের বৈধতা নিশ্চিত করেছে। এই রায় ব্যবসায়িক চুক্তি এবং সততার প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে।”

তিনি বলেন, ‘শেফ অনলাইন প্ল্যাটফর্মের অধীনে লে শেফ পিএলসি রেস্টুরেন্ট এবং টেকওয়ের জন্য উদ্ভাবনী অনলাইন সমাধান প্রদানের মিশন চালিয়ে যাবে। আমরা কারি শিল্পে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার পাশাপাশি পেশাদারিত্ব ও সততার সর্বোচ্চ মান বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

error: