নাহিদ হত্যায় জড়িতরা গোয়েন্দা নজরদারিতে

নিউ মার্কেটে শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষে নিহত কুরিয়ার সার্ভিস কর্মী নাহিদ মিয়া হত্যাকাণ্ডের আসামিদের এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ঘটনার সাতদিন পরেও তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন ফুটেজ বিশ্লেষণ করে যাচাই-বাছাই চলছে। এ ঘটনায় অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। অথচ বিভিন্ন গণমাধ্যমে ঘটনার দিন নাহিদকে যারা কুপিয়েছিল তাদের ছবি, নাম ও পরিচয় প্রকাশ করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কারা জড়িত তা অনেকটাই স্পষ্ট। কিন্তু তাদেরকে এখনও গ্রেপ্তার বা আইনের আওতায় কেন আনা হচ্ছে না- এ নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের হিসাব মেলাতে পারছেন না ভুক্তভোগীর পরিবার ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। কারণ সময় যত গড়াচ্ছে জড়িতরা চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছে।
শনিবার পর্যন্ত যারা কলেজ ছাত্রাবাসে অবস্থান করছিলেন রোববার থেকে তাদের অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছে।

তাদের অনেকেই মোবাইল বন্ধ রেখেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজন থেকেও নিজেদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি বিশ্বস্তসূত্র বলছে, নাহিদ হত্যাকাণ্ডে জড়িত অনেকেই এখন গোয়েন্দাজালে রয়েছেন। এছাড়া নজরদারিতে রাখা হয়েছে আরও কয়েকজনকে। যেকোনো সময় তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হবে। এ ঘটনায় জড়িতদের প্রকাশ্য আনার জন্য রাতদিন কাজ করছে ডিবি ও র‌্যাব সদস্যরা।
সূত্রগুলো বলছে, নাহিদ হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত তারা ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাদেরকে গ্রেপ্তারের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে গোয়েন্দা পুলিশ ও র‌্যাব’র টিম। গতকাল লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার কমলাবাড়ী ইউনিয়নের ভেটেশ্বর গ্রাম থেকে ফিরোজ রাব্বী নামের ঢাকা কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞান দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে আনা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তার পরিবার। তাদের দাবি, র‌্যাব ওইদিন ভোরে ৫টি মাইক্রোবাসে করে তার বাড়িতে অভিযান চালায়। কেন তাকে তুলে নেয়া হচ্ছে পরিবারের এমন প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব সদস্যরা জানিয়েছেন নিউ মার্কেটের ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে নেয়া হচ্ছে। তবে রাব্বিকে তুলে আনার সত্যতা যাচাই করা যায়নি। কলেজসূত্র বলছে, রোববার ৬ জন শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ডিবি ও র‌্যাব তাদের ৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দিয়েছে। বাকি একজন এখনও তাদরে হেফাজতে আছেন বলে দাবি করেছেন ঢাকা কলেজের একজন প্রভোস্ট।
গোয়েন্দা পুলিশ ও র‌্যাব’র একটি সূত্র জানিয়েছে, ঘটনার দিন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংঘর্ষে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ নেতা জসিম উদ্দিন, ফিরোজ হোসেন ও জুলফিকারের অনুসারীরা অংশগ্রহণ করে। তারা সবাই কলেজ ছাত্রলীগের বিলুপ্ত হওয়া কমিটির নেতা। তবে এই তিন নেতার অনুসারীদের মধ্যে ঘটনার দিন জসিমের অনুসারীরা বেশি আগ্রাসী ছিলেন। তারা ঘটনার পুরো সময়কে উত্তপ্ত করে রেখেছিলেন। সংঘর্ষের সময় তিনটি গ্রুপের অনেকেই দেশীয় তৈরি অস্ত্র, লোহার রড ও লাঠি বহন করছিলেন। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা ফুটেজ দেখে তাদের অনেককেও শনাক্ত করেছেন। এছাড়া নাহিদকে যে দু’জন কুপিয়েছে তাদের একজন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী ও বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে শিক্ষার্থী ইমন বাশার। তার বাড়ি খুলনার পাইকগাছায় নাহিদকে কোপানোর ছবি ভিডিওতে তাকে স্পষ্ট দেখা গেছে। ইমন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ নেতা সামাদ আজাদ জুলফিকারের অনুসারী। গণমাধ্যমে তার ছবি ও পরিচয় প্রকাশের পর তিনি ক্যাম্পাস ছেড়ে পালিয়েছেন। রোববার ডিবি’র একটি টিম কলেজের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসের ইমনের রুমে অভিযান চালিয়ে দু’টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করেছে। এছাড়া নাহিদকে প্রথম আঘাত করেছিল ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী কাইয়ুম। ঘটনার সময় তার পরনে সাদা ডোরাকাটা নীল টি-শার্ট ছিল। তাকেও চিহ্নিত করা হয়েছে। কাইয়ুম ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী। বাড়ি নেত্রকোনা জেলায়। ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের জসিমের অনুসারী।
তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে ডিবি’র রমনা জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার আজিমুল হক বলেন, নাহিদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে অনেক নাম আসছে। আমরা সেগুলো যাচাই- বাছাই করছি। ফুটেজ থেকে পাওয়া ছবির সঙ্গে তাদের মেলাচ্ছি। আটকের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভিযুক্তরা শিক্ষার্থী হওয়াতে পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। তবে আমাদের তদন্তের অগ্রগতি আছে।
ঢাকা কলেজের দক্ষিণ হল ছাত্রাবাসের প্রভোস্ট আনোয়ার মাহমুদ মানবজমিনকে বলেন, ডিবি ও র‌্যাব মিলে ৬ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে আমার জানামতে ৫ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এদের একজনকে আমার জিম্মায় নিয়ে এসেছি। আর বাকি ৪ জনকে যারা নিয়েছিল তারা কলেজের সামনে দিয়ে গেছে। যাদেরকে নেয়া হয়েছিল তাদেরকে কি বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি দক্ষিণ হলের প্রভোস্ট। আর যাদেরকে নেয়া হয়েছে তারা উত্তর ও আন্তর্জাতিক হলের শিক্ষার্থী। কলেজ প্রশাসনের হয়ে আমি নিয়ে এসেছি। তবে তাদেরকে আমি কিছু জিজ্ঞাসাও করিনি তারাও কিছু বলেনি। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কলেজে এখন খুব কম শিক্ষার্থী আছে। ২/১ দিনের ভেতরে সব খালি হয়ে যাবে। আর যারা অন্য ধর্মের আছে তাদেরকে আমরা বাড়ি যেতে বলতে পারি না।
এদিকে আমাদের লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, র‌্যাব পরিচয়ে লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলার কমলাবাড়ী ইউনিয়নের ভেটেশ্বর গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে ফিরোজ রাব্বী (২২) নামে ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থীকে তুলে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তার পরিবার। সোমবার ভোররাতে তাকে ৫টি মাইক্রোবাসযোগে তুলে নেয়া হয়। ফিরোজ রাব্বী ঢাকা কলেজ এর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।
রাব্বীর বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক জানান, তার ছেলে ফিরোজ রাব্বী ঢাকা কলেজের ছাত্র। তাকে র‌্যাব-১৩ পরিচয়ে মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে গেছে। কি কারণে তার ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে- জানতে চাইলে তারা বলে- ঢাকা নিউ মার্কেটের ঘটনার ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য নেয়া হচ্ছে। রাব্বীর মা অশ্রুসিক্ত হয়ে জানান, তার ছেলে কিছুতেই জড়িত নয়। ঢাকায় নিউ মার্কেটে ঘটনার দিন তার ছেলে বাড়িতে ছিল। ফিরোজ রাব্বীর বড় ভাই আবু রায়হান মানবজমিনকে বলেন, ঢাকা নিউ মার্কেটে ঘটনার সময় আমার ভাই ফিরোজ রাব্বী বাড়িতে ছিল। রোববার ভোররাতে র‌্যাব’র লোকজন তাকে নিয়ে গেছে রংপুরে। আমি রংপুর র‌্যাব শাপলা এলাকার অফিসে গিয়ে দেখি-আমার ভাই সেখানে রয়েছে। আমি তার সঙ্গে কথাও বলেছি।
তবে র‌্যাব-১৩ এর লালমনিরহাট জেলার ইনচার্জ জানান, ফিরোজ রাব্বী নামের কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। আদিতমারী থানার অফিসার ইনচার্জ মোক্তাদির রহমান বলেন, র‌্যাব’র লোকজন অভিযান চালিয়েছে শুনেছি। তবে কী অভিযান, কাকে নিয়ে গেল সে বিষয়ে আমাদের কিছু জানায়নি।
নিউ মার্কেটের ঘটনায় ফুটেজ দেখে ব্যবস্থা: গতকাল দুপুরে তেজগাঁও সরকারি বিজ্ঞান কলেজে ঈদবস্ত্র বিতরণ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, নিউ মার্কেটে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের সংঘর্ষের ঘটনায় ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে যারা চিহ্নিত হবে, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সংঘর্ষের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা নিজস্ব গতিতে চলবে। তিনি বলেন, আপনারা জানেন এখানে দু’টি হত্যা কিংবা এক্সিডেন্ট যেটাই বলেন, দু’টো ঘটনা ঘটেছে। যা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ঘটেছে। মৃত্যু কারও জন্য কাম্য নয়, সে যেই হোক। আমরা দেখেছি একটা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত। এই সূত্রপাত থেকে বৃহদাকার একটা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। এখানে ছাত্র, ব্যবসায়ী, ছোট ছোট ক্ষুদে দোকানদার-তারা এই যুদ্ধে লিপ্ত হন। অন্যদের পাশাপাশি সাংবাদিকরাও আহত হয়েছেন। পরে আপনারা দেখেছেন, আমাদের পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিয়েছে।

error: