নির্বাচন আইসিইউতে,গনতন্ত্র লাইফ সাপোর্টে: মাহবুব তালুকদার

মাহবুব তালুকদার

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ যতই ফুরিয়ে আসছে, নির্বাচন ব্যবস্থা ও অবস্থা দেখে ততই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছি। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন এখন আইসিইউ-তে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে গণতন্ত্র এখন লাইফ সাপোর্টে। দেশে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অসহিষ্ণু মনোভাব গণতন্ত্রকে অন্তিম অবস্থায় নিয়ে গেছে। খেলায় যেমন পক্ষ-বিপক্ষের প্রয়োজন হয়, তেমনি একপক্ষীয় কোনো গণতন্ত্র হয় না। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে কোনো মূল্যে গণতন্ত্রকে আমরা লাইফ সাপোর্ট থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চাই। এজন্য দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এই সংকট নিরসনে সকল দলের সমঝোতা অপরিহার্য।
বোরবার বিকেলে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে ‘দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ বিষয়ক এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
মাহবুব তালুকদার বলেন, সংবিধানের বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও সুদীর্ঘ ৫০ বছরে নির্বাচন কমিশন গঠন আইন প্রণয়ন করা হয়নি।

নির্বাচন প্রক্রিয়া সংস্কারের জন্য এই আইন প্রণয়ন অবধারিত হলেও তা যথেষ্ট নয়। এতে নিরপেক্ষভাবে সব রাজনৈতিক দলের স্বার্থ সংরক্ষণ করা আবশ্যক এবং তা সকল দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। একপক্ষীয় আইন করে কোনো লাভ হবে না। একপক্ষীয় আইন কেবল একদলীয় শাসনের পথ উন্মুক্ত করে। বিষয়টির যত তাড়াতাড়ি ফয়সালা হয় ততই মঙ্গল। নইলে দেশব্যাপী নৈরাজ্যের আশঙ্কা আছে।
তিনি বলেন, এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে রক্তাক্ত নির্বাচন বললে অত্যুক্তি হবে না। নির্বাচনের সময় ও তার আগে পরে এ পর্যন্ত ৩৯ জন নিহত হন। জীবনের চেয়ে নির্বাচন বড় নয় এই বার্তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাছে পৌঁছাতে সম্ভবত ব্যর্থ হয়েছি। গত ১১ই নভেম্বর ৮৩৪টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৮০ জন চেয়ারম্যান পদে আসীন হন। একে আক্ষরিক অর্থে নির্বাচন বলা যায় না। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, সেখানে নির্বাচন নেই। ইউপি নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে না হয়ে পূর্বের ন্যায় সবার জন্য উন্মুক্ত হলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত’ হওয়ার সুযোগ থাকবে না।
মাহবুব তালুকদার বলেন, আমার মতে পৃথক একটি স্থানীয় নির্বাচন কর্তৃপক্ষ গঠন করে এসব নির্বাচন করা যায়। যে নির্বাচন প্রক্রিয়া নির্বাচন কমিশন ঠিক করে না, তার দায় কমিশন কেন নেবে? তবে এই পরিবর্তন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার।
তিনি আরো বলেন, জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের বড় সমস্যা হলো রিটার্নিং অফিসারগণকে রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের কিংবা স্থানীয় নেতাদের প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত মনোভাব অনুধাবন করে চলতে হয়। ফলে তারা হানাহানি, গোলযোগ ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো ধামাচাপা দিতে চান। তাদের ধামাধরা না হয়ে উপায় থাকে না। বিভিন্ন নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে আমার এই ধারণা হয়েছে। তাদেরকে নির্বাচনে সাহসী ভূমিকা পালনের কথা বলে লাভ নেই। স্থানীয় ক্ষমতাধরদের রোষানল থেকে রক্ষা করতে সাহসী রিটার্নিং অফিসার ও সাহসী কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা বা নিরাপত্তা দেয়ার নজির নেই।
নির্বাচন কমিশনার বলেন, বিশ্বে আদর্শ নির্বাচনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা ও চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা। আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাওয়া কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান, সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত সদস্য পদে ৬৫ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসন লাভ করেন। অন্যদিকে রাউজান উপজেলায় ১৪ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, ১২৬ জন পুরুষ ও ৪২ জন সংরক্ষিত আসনের সদস্য সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পদে আসীন হয়েছেন। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো উপজেলায় চেয়ারম্যান ও সদস্যের ১৮২টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন না হয়ে নির্বাচিত হন। নির্বাচনে কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী বা প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ছিল খুবই শান্তিপূর্ণ। সারা দেশে যদি সন্ত্রাসমুক্ত এ ধরণের নির্বাচন করা যায়, তাহলে নির্বাচন কমিশনের বদলে একজন সচিবের অধীনে একটি সচিবালয় থাকলেই যথেষ্ট।

error: