ভারতে কৃষক আন্দোলন তুঙ্গে, দিনব্যাপী অনশনে কৃষকরা

ভারতে সম্প্রতি পাশ হওয়া নতুন তিনটি কৃষি আইন বাতিলের জন্য নরেন্দ্র মোদি সরকারের উপর চাপ জোরদার করতে সোমবার দিনব্যাপী অনশন পালন করেছে কৃষকরা। এরফলে কৃষকদের চলমান বিক্ষোভ ১৯তম দিনে এসে আরো গতি পেয়েছে। এদিন সারা ভারতে হাজার হাজার কৃষক সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দাবি আদায়র জন্য অনশন করেছে।

কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন আইনের ফলে কৃষকদের উৎপাদিত ফসল সরকার পরিচালিত পাইকারী বাজারের (যেখানে কৃষকরা তাদের শষ্যের ন্যায্য মূল্যের নিশ্চয়তা পায়) পরিবরর্তে বেসরকারি ক্রেতাদের কাছে বিক্রির সুযোগ সৃষ্টি করবে; যা ভারতের বিশদ কৃষি খাতকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করবে।

কিন্তু কৃষকরা জানিয়েছে, আইনটি তাদের উপার্জনের জন্য হুমকি। এটা শুধুমাত্র বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাভবান করবে এবং কৃষকদেরকে মুক্ত বাজারের করুণার পাত্র করে দিবে।

কৃষক নেতা দর্শন পালন বলেছেন, ‘আজ আমরা ভারতের সকল জেলায় আন্দোলনের ডাক দিয়েছি। বিভিন্ন কৃষক সংগঠনের মূল নেতারা নতুন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অংশ হিসেবে উপবাস পালন করছে।’
সরকার তাদেরকে আবারো আলোচনায় ডাকলে ‘আমরা এটাকে ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করবো’ বলে জানিয়েছেন তিনি।

দুই সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় বারের মতো কৃষকরা দেশব্যাপী এই আন্দোলনের ডাক দিয়েছে এবং জনগণকে দেশব্যাপী জেলা অফিসগুলোর বাইরে অবস্থান কর্মসূচী পালন করতে বলেছে।

ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির বাইরে হাজার হাজার কৃষকের অবস্থান শিবির এবং শহরগামী মহাসড়ক অবরোধের মধ্য দিয়ে আন্দোলন এগিয়ে যাচ্ছে।

সোমবার কৃষকদের সাথে অনশন পালনের মধ্য দিয়ে দিল্লীর মূখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং তার আম আদমি পার্টি কৃষকদের প্রতি তাদের সহযোগিতা বাড়িয়েছে।

কেজরিওয়াল তার দলের সমর্থকদের আন্দোলনে যোগদানের আহ্বান জানিয়েছে এবং মোদি সরকারের ভারতীয় জনতা পার্টিকে (বিজেপি) তাদের ‘ঔদ্ধত্ব পরিহার’ করে কৃষকদের দাবী মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

এদিকে, মন্ত্রীর কৃষকদের সাথে আলোচনায় বসার আগে এই আন্দোলনের ব্যাপারে গণমাধ্যমে কোন কথা বলতে দল থেকে ‘নির্দেশ’ করেছে উল্লেখ করে বিজেপি’র একজন মুখপাত্র এই বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হন নি।

গত সপ্তাহে, কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীসহ একদল বিরোধী দলীয় নেতা ভারতের রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোভিন্দের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন এবং তাকে আইনটি বাতিলের জন্য বলেছেন।

মহামারী সংকটের মধ্যে আইন
ভারতের ২.৯ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে ১৫ ভাগ অবদান রাখছে কৃষি এবং দেশের ১.৪ বিলিয়ন জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশী মানুষের কর্মসংস্থান করছে এটি। বর্তমানে এই খাতটি সংকটের মুখোমুখি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাজার হাজার ঋণগ্রস্থ কৃষক তাদের জীবন সংহার করেছে।

দেশটির অর্থনীতির আরেক ধাপ ক্ষতি করা মহামারী করোনাভাইরাসের মধ্যে ডানপন্থী বিজেপি সরকার সেপ্টেম্বরে তিনটি কৃষি সংস্থা আইন পাস করেছে।

মোদি বলেছেন, কৃষিক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করার জন্য আইনটির দরকার ছিল এবং নতুন আইন কৃষকদের উপকার করবে এবং মধ্যস্বত্বভোগিদের অত্যাচার থেকে তাদের ‘মুক্তি দেবে’।

তবে হরিয়ানা এবং ভারতের শস্যের বাটি হিসেবে খ্যাত পাঞ্জাব রাজ্য থেকে আসা বেশিরভাগ কৃষকরা এই আইনটিকে ‘কৃষক বিরোধী’ বলে গালিগালাজ করেছেন। কৃষক প্রতিনিধি ও সরকারের মধ্যে বেশ কয়েক দফা আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে।

কৃষকরা চায় তিনটি আইন সম্পূর্ণ বাতিল এবং তাদের উৎপাদনের জন্য সরকার কর্তৃক গ্যারান্টিযুক্ত একটি ন্যূনতম সহায়তা মূল্য (এমএসপি)।

গত সপ্তাহে, সরকার কৃষকদের ইউনিয়নগুলিতে একটি লিখিত প্রস্তাব পাঠিয়েছিল, যাতে এমএসপি নিয়ে লিখিত নিশ্চয়তা সহ একাধিক সংশোধনী রেখেছিল।

কিন্তু কৃষকরা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। কৃষক নেতা হানান মোল্লা বলেছেন, ‘সরকারের প্রস্তাবটি ছিল নিছক প্রতারণা’।

‘কৃষকরা তিনটি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করার পর থেকে কয়েক মাস পার হয়ে গেছে এখন। কৃষি সংস্থা আইনের প্রতি আমাদের অসন্তোষ দেখিয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রীকে বেশ কয়েকটি স্মারকলিপি প্রেরণ করেলেও সরকার তাতে কোন কর্ণপাত করছে না,’ জানিয়েছেন তিনি।

‘সরকার কৃষকদের যে প্রস্তাব দিচ্ছে তা হলো কসমেটিক পরিবর্তন তবে এই পরিবর্তনগুলি আইনের চরিত্রকে পরিবর্তন করবে না।’
মোল্লা বলেন, কৃষকদের জন্য একমাত্র যে পথটি খোলা আছে তা হলো গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া।
সিংহু সীমান্তে, বিক্ষোভকারী কৃষকরা তাঁবু গেড়েছেন। এর মধ্যে প্রার্থণার জন্য একটি ও অন্য একটি পাঠাগারের জন্য রয়েছে। প্রতিবাদী কৃষকদের বিনামূল্যে চিকিত্সা সুবিধা প্রদানের জন্য কয়েকটি মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে এবং কয়েক ডজন ‘ফ্রী কিচেন’ বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ করছে।
বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা কেবল বেড়েই চলেছে, বয়স্ক মহিলাসহ আরও বেশি সংখ্যক লোক তাদের সাথে যোগ দিচ্ছে।

কর্নাইল কৌর (৭৫) নামক একজন বলেন, তিনি পাঞ্জাব রাজ্যের মোগা জেলা থেকে সিংহু সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় ৩২০ কিলোমিটার (২০০ মাইল) পথ ভ্রমণ করে এসেছন।
প্রবীণ মহিলার সাথে আসা নাতনি রামান্দিপ কৌর জানান, বৃদ্ধ বয়স ও অসুস্থ শরীর স্বত্ত্বেও তিনি বাড়িতে থাকতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন এবং জোর করেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন।

‘যতক্ষণ না মোদি এই আইনগুলি প্রত্যাহার না করে, আমরা আর ফিরে যাব না,’ প্রবীণ কৌর বলেছিলেন। ‘মোদি পাঞ্জাবিদের প্রতিজ্ঞা সম্পর্কে জানা উচিত।’ কয়েক গজ দূরে বসেছিলেন পাঞ্জাবের বাটালা শহর থেকে আসা ৬৫ বছরের বালজিন্দর কৌর। তিনি বলেন, নয়াদিল্লির বাইরে বিক্ষোভকারী অনেক পরিবার তাদের বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন।

‘আমরা বুঝতে পারি যে এই আইনগুলি আমাদের কী করতে পারে। সে কারণেই আমরা প্রতিবাদ করতে এতদূর এসেছি,’ তিনি বলেছিলেন। ‘আইনগুলি ফিরিয়ে নেওয়া হলেই কেবল আমরা আমাদের বাড়িতে ফিরে যাব।’

সূত্র : আলজাজিরা

error: